মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের প্রশাসনিক মানচিত্রে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে-যেখানে ফরিদপুর বিভাগ প্রায় ঘোষণার দোরগোড়ায়,সেখানে নোয়াখালী বিভাগ আজও“কমিটি করবে, রিপোর্ট দেবে, ভাববে”-এই চক্রে ঘুরছে।কেন?কার স্বার্থে এই দেরি?কোন অদৃশ্য শক্তি বৃহত্তর নোয়াখালীর উন্নয়ন,সম্ভাবনা আর আত্মসম্মানকে আটকে রেখেছে?এ প্রশ্ন আজ নোয়াখালীর প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে প্রবাসের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
নোয়াখালী-যে অঞ্চল শুধু একটি জেলা নয়,এক ইতিহাস
এই অঞ্চল বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত বাতাস,নদীভাঙা মাটি, পরিশ্রমী মানুষ, এবং এক অবিনশ্বর আত্মমর্যাদার প্রতীক।
নোয়াখালীর মানুষ শ্রমে, বুদ্ধিতে,উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রতিটি খাতে অবদান রেখেছে।কৃষি থেকে ব্যবসা,শিক্ষায় থেকে সাংবাদিকতায়,প্রবাস থেকে রাজনীতিতে-যেখানেই গেছেন, সেখানেই নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তবু প্রশাসনিক কাঠামোর সুবিধা ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের বণ্টনে নোয়াখালীকে সবসময় প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত নোয়াখালীর উন্নয়ন পরিকল্পনা কখনোই কেন্দ্রীয় অগ্রাধিকারে আসেনি।
বরং এক অদৃশ্য রাজনৈতিক ভারসাম্যের নামে নোয়াখালীর দাবি “পরে দেখা হবে” বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিভাগীয় দাবি:একটি ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন
নোয়াখালী বিভাগ দাবি কোনো আবেগ নয়-এটি জনসংখ্যা, ভৌগোলিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রশাসনিক কার্যকারিতার যৌক্তিক দাবি।
জনসংখ্যা:বৃহত্তর নোয়াখালী(নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর) মিলে প্রায় এক কোটি মানুষ।বাংলাদেশের অনেক বিদ্যমান বিভাগের চেয়েও বেশি।
অর্থনৈতিক অবদান:এই অঞ্চল থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় আসে-যা জাতীয় বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস।তারপরও এখানে কোনো আধুনিক বিমানবন্দর নেই,শিল্পাঞ্চল নেই,এমনকি উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোও মানহীন।
ভৌগোলিক গুরুত্ব:এই অঞ্চল বঙ্গোপসাগর,সোনাপুর সমুদ্র সৈকত, চরাঞ্চল ও নৌপথের কৌশলগত স্থানে অবস্থিত-যা ভবিষ্যৎ ব্লু-ইকোনমি, গভীর সমুদ্রবন্দর ও নৌবাণিজ্যের হাব হতে পারে।তবু কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণে এ অঞ্চলের সম্ভাবনা এখনো “ফাইলের নিচে চাপা”।
ফরিদপুরে বিভাগ নোয়াখালীতে অপেক্ষা-এ কেমন রাষ্ট্রনীতি?যখন দেখা যায়, ঢাকার পাশের ফরিদপুরে “রাজনৈতিক সুবিধা”র কারণেবিদ্যুৎ গতিতে বিভাগ ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়,তখন নোয়াখালীর জনগণের মনে একটাই প্রশ্ন জাগে-এই রাষ্ট্র কি কেবল রাজধানীর চারপাশের জন্যই?
নোয়াখালী,ফেনী,লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকা যেতে ৬-৭ ঘণ্টা লেগে যায়।এত বিশাল জনপদের প্রশাসনিক সেবা পরিচালনা চট্টগ্রাম বা কুমিল্লা থেকে করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।তবু ক্ষমতার কেন্দ্র কখনো এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেয়নি।কারণ নোয়াখালী সবসময় রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনচেতা, বিদ্রোহী ও গণসচেতন।এই স্বাধীনচেতা জনপদকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন-তাই উন্নয়নের বরাদ্দেও এখানে সবসময় রাজনীতির হিসাব চলে।
“নোয়াখালী বিভাগের আন্দোলন”-শুধু দাবি নয়, আত্মসম্মানের নবজাগরণআজ ফেনী,নোয়াখালী,লক্ষ্মীপুরের রাস্তায় যে হাজারো মানুষের স্লোগান উঠছে-“আমরা বঞ্চিত, আমরা বিভাগ চাই”-এটা শুধু একটি প্রশাসনিক দাবি নয়,এটা এক জাতিগত পুনরুত্থান।
এ আন্দোলনে শ্রমিক,ছাত্র,ব্যবসায়ী,সাংবাদিক প্রবাসী-সবাই একসাথে।তারা বলছে-“আমাদের টাকা দিয়ে রাষ্ট্র চলে, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন মরে।”এই স্লোগান শুধু কাগজে নয়, মানুষের হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।যেভাবে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য মানুষ জেগেছিল,যেভাবে ২০২৪-২৫ সালের প্রজন্ম জেগেছিল দুর্নীতি ও দমননীতির বিরুদ্ধে,ঠিক তেমনি দেশে-বিদেশে নোয়াখালীর মানুষ আজ জেগেছে ন্যায়বিচার ও স্বীকৃতির জন্য।
৫টি প্রশাসনিক যুক্তি:কেন এখনই নোয়াখালী বিভাগ অপরিহার্য-জনসংখ্যা ভারসাম্য:চট্টগ্রাম বিভাগে জনসংখ্যার ঘনত্ব এত বেশি যে প্রশাসনিক দক্ষতা ব্যাহত হচ্ছে।নোয়াখালী বিভাগ হলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রশাসনিক ভারসাম্য ফিরে আসবে।
কেন্দ্র গড়ে তোলা:ফেনীর শিল্পাঞ্চল,নোয়াখালীর চৌমুহনী-বেগমগঞ্জ অর্থনীতি,লক্ষ্মীপুরের কৃষি ও প্রবাস আয়ের সমন্বয়ে একটি নতুন মিনি-ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা সম্ভব।
ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা:সমুদ্র উপকূল ও চরাঞ্চল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতির কেন্দ্র।একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক ইউনিট ছাড়া এ অঞ্চল নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকবে।
সেবা ও অবকাঠামো উন্নয়ন:শিক্ষা,স্বাস্থ্য,পরিবহন-সব ক্ষেত্রে নোয়াখালী পিছিয়ে।বিভাগ হলে স্থানীয় বাজেট,অফিস, নিয়োগ ও সেবায় স্বায়ত্তশাসন বাড়বে।
এখন সময় সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের
ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে কাজ করছে।
এই সংস্কারের সবচেয়ে জরুরি অংশ হতে হবে বিভাগীয় ভারসাম্য পুনর্গঠন।যদি ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়, তবে নোয়াখালী বিভাগ ঘোষণাই হবে সেই ন্যায়ের প্রথম বাস্তব পরীক্ষা।
নোয়াখালী কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য নয়-এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের আত্মসম্মানের প্রতীক।আজ নোয়াখালী যদি নিজের প্রশাসনিক মর্যাদা না পায়,তবে আগামীতে অন্য সব প্রান্তিক অঞ্চলের ন্যায়বিচারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আমরা কারো দয়া চাই না,অধিকার চাই
নোয়াখালীর মানুষ দান নয়,অধিকার দাবি করে।
আমরা কর দিই, শ্রম দিই, রেমিট্যান্স পাঠাই-তারপরও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে আমরা সর্বদা প্রান্তিক!
এই অন্যায় আর চলবে না।
আজ সময় এসেছে এক ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তোলার- “নোয়াখালী বিভাগ চাই-এখনই!”এই দাবির ভেতর আছে বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কারের আগুন,সমতার ন্যায়ের বার্তা,আর এক নতুন প্রজন্মের জাগরণ। নোয়াখালী বিভাগ মানে শুধু নতুন মানচিত্র নয়-এটা এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার সূচনা,যেখানে প্রতিটি প্রান্তিক অঞ্চলের কণ্ঠ রাষ্ট্রের কেন্দ্রে প্রতিধ্বনিত হবে।
লেখক: মো: আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক, নবজাগরণ
জুলাই যোদ্ধা-আহত সাংবাদিক
সবাই শেয়ার করুন-অনলাইনে পড়তে: wwww.thenabajagaran.com





