মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশ আজ এক ভয়াবহ বাস্তবতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আমরা অনেকেই প্রতিদিন খবর দেখি, শুনি-কিন্তু গভীরে গিয়ে যে বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি তা বুঝতে চাই না, কিংবা মানুষকে বুঝতে দেওয়া হয় না। অথচ পরিসংখ্যান এখন আর শুধু সংখ্যা নয়-এটি জাতির সংকটের নথি, আমাদের ভবিষ্যতের অন্ধকার মানচিত্র।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সরকারি ঋণ ২১ ট্রিলিয়ন-অর্থাৎ ২১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এর মানে কী জানেন?আজ এই দেশে একটি শিশু জন্মালেই, সে কাঁধে নিয়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় সোয়া লাখ টাকার ঋণ। এটা কি উন্নয়ন? নাকি জাতির ভবিষ্যৎকে বন্ধক রেখে “মেগা উন্নয়ন”-এর আড়ালে মেগা লুটপাট?ঋণের হিসাব দেশের নয়,শাসকের ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা গত এক বছরে দেশের ঋণ বেড়েছে ১৮.৮৯- ২১.৪৪ ট্রিলিয়ন,অর্থাৎ মাত্র ১২ মাসে প্রায় ১৪% বৃদ্ধি। এটা কোনো স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল নয়-এটি অদক্ষতা + অপচয় + দুর্নীতি + অন্ধ রাজনীতি-এই চার উপাদানের বিষাক্ত মিশ্রণ।
রাজস্ব আদায় যেখানে ভেঙে পড়ে আছে,ব্যর্থ প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা ডুবে যাচ্ছে,বিদেশি ঋণের শর্ত হয়েছে কঠোর,বাজেট সুদের চাপে হাঁসফাঁস করছে-এই অবস্থায় ঋণ বাড়া ছাড়া আর কী-ইবা হওয়ার কথা?কিন্তু সরকার, শাসকেরা, ক্ষমতার সর্দাররা-সব ঠিক আছে বলেই মুখ খোলা রাখেন।কারণ তাদের সন্তান জন্ম নিলে ঋণ কাঁধে আসে না।তাদের বাড়ি,গাড়ি,ব্যাংক ব্যালেন্স-সব অক্ষত থাকে। জনগণের কাঁধেই তারা দেয় সব বোঝা।
“মেগা উন্নয়ন”না কি“মেগা দুর্নীতি”?
বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পগুলো-ব্রিজ,এক্সপ্রেসওয়ে, পাওয়ার প্ল্যান্ট,রূপপুর,পদ্মা-যা-ই নাম বলি-এগুলো কাগজে উন্নয়ন, কিন্তু ভেতরে এক বিশাল অপচয় ও অতিরিক্ত ব্যয়ের খনি। যা পাওয়া যায়-ব্যয়ের তুলনায় আয় নেই।ঋণ শোধ করতে গ্রেস পিরিয়ড নেই।প্রকল্পের ব্যয় তিনগুণ করে দেখানো হয়।চুক্তি হয় দলীয় সুবিধাভোগীদের হাতে।আর লুটপাট হয় হাজার কোটি টাকার।এগুলো উন্নয়ন নয়-উন্নয়নের নামে জনগণের ভবিষ্যৎ বন্ধক রাখা।যেখানে একটি হাসপাতালের ওষুধ নেই,একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নেই,দারিদ্র্য-সুরক্ষা কর্মসূচি ভেঙে পড়েছে-সেখানে আকাশচুম্বী প্রকল্প দেখিয়ে যে উন্নয়ন প্রদর্শন, তা আসলে একটি সাজানো নাটক।
বিদেশি ঋণের দাসত্ব-দেশের ভবিষ্যৎ বন্ধক
বাংলাদেশের মোট সরকারি ঋণের প্রায় ৪৪% বিদেশি ঋণ।
এর বেশিরভাগই কম অনুদানমূলক (low-concessional)
-অর্থাৎ সুদ বেশি,সময় কম,শর্ত কঠোর। যে সরকারের দুর্বলতা:কূটনীতিতে ব্যর্থ,অর্থনৈতিক নীতিতে অদক্ষ,
রাজনৈতিকভাবে দুর্বল,জনগণের কাছে দায়হীন-সেই সরকারের হাতে বিদেশি ঋণ মানে হলো নিজের ভবিষ্যৎ স্বেচ্ছায় বন্ধক রাখা। ঋণের ভাষ্য স্পষ্ট-বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক দাতাদের আস্থার ঘাটতিতে ভুগছে।এর ফলস্বরূপ,বিদেশি ঋণের সুদের হার বাড়ছে,শর্ত বাড়ছে,চাপ বাড়ছে। এটা শুধুই অর্থনৈতিক সমস্যা নয়-এটি একটি রাজনৈতিক দাসত্ব।
বাজেটের রক্তক্ষরণ-সুদের পিছনে দেশের জীবন
ঋণ বাড়লে বাজেটের প্রথম আঘাতটিই আসে কোথায়?
সুদ পরিশোধে।আজ বাংলাদেশের বাজেটে:সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে সুদের খরচ সবচেয়ে কম বাড়ছে স্বাস্থ্য ব্যয়
সবচেয়ে সংকুচিত শিক্ষা সবচেয়ে অনিরাপদ সামাজিক সুরক্ষা যেখানে দরকার-স্কুলে মানসম্মত শিক্ষক হাসপাতালের বেড গ্রামে-গঞ্জে স্বাস্থ্যকেন্দ্র কর্মসংস্থানের সুযোগ পরিবেশ সুরক্ষা কৃষি উন্নয়ন
সেখানে বরাদ্দ বাড়ে না-কারণ বাজেটের বড় অংশ সুদ খেয়ে ফেলছে।এভাবে একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও দেউলিয়া হয়। যখন রাজনীতি হয় লোভের ব্যবসা-অর্থনীতি ডুবে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন সত্যের সামনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের।যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৪ বছরে দেশকে এমনভাবে চালিয়েছে যে-নেতা আছে, কাজ নেই নেতার বাড়ি আছে, আয় নেই নেতার গাড়ি আছে,কর নেই নেতার ক্ষমতা আছে,যোগ্যতা নেই!
দল ক্ষমতায় আসলেই নেতা রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হয়-এই চক্রটাই দেশের জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংস করেছে।প্রকল্পের টেন্ডার নেতা পায়,বাজেটের সুবিধা নেতা পায়,জমি নেতা দখল করে,লাইসেন্স নেতা পায়,পদোন্নতি নেতা পায়,চাকরি নেতা বণ্টন করে।রাষ্ট্র তো জনগণের নয়-রাষ্ট্র হয়ে যায় “দলদাসদের অংশীদারি কোম্পানি।”
শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান:ঋণের শিকলে আটকে যাওয়া ভবিষ্যৎ আজকের বাংলাদেশ ভয়াবহ তিনটি সংকটের মধ্যে-শিক্ষার সংকট-টাকার অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যের সংকট-ওষুধ নেই,চিকিৎসা নেই,সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই।কর্মসংস্থান সংকট-কারখানা বন্ধ,রপ্তানি কমছে,বেকারত্ব বাড়ছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর হলো-SSC পরীক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী ফেল করছে-এটি অক্ষম শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে প্রাইভেট কোচিং করতে হয়,ডাক্তারের কাছে যেতে হলে টাকা লাগে,চাকরির জন্য ঘুষ লাগে।অর্থাৎ-একজন তরুণ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঋণ + ব্যর্থতা + দুর্নীতি-এই তিনের গোলকধাঁধায় আটকে থাকে।
নেতৃত্বের সংকটই আজকের ঋণ-দুরবস্থার মূল কারণ
বাংলাদেশের আসল সমস্যা অর্থনীতি নয়-সমস্যা হলো নেতৃত্ব।একটি দেশ তখনই উন্নত হয় যখন-নেতৃত্ব সৎ শাসন স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত দক্ষ নীতি জনগণের জন্য কিন্তু গত ১৫ বছরে আমরা কী দেখেছি? দুর্বৃত্তায়ন, দলদাসীকরণ চাটুকারিতার সংস্কৃতি মূল্যবোধহীন লোভ অযোগ্যদের পদোন্নতি ঘুষের বিনিময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা যে রাষ্ট্রে দক্ষ নেতৃত্ব নেই, সেই রাষ্ট্র কখনই ঋণমুক্ত হতে পারে না।
পরিবর্তনের ডাক-এখনই সময়
বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে।
যদি এখন দিক পরিবর্তন না করি-ঋণ বাড়তেই থাকবে
সুদের চাপ বাড়বে বাজেট সংকুচিত হবে প্রকল্পের ব্যয় ফুলবে জনগণের জীবন আরো কঠিন হবে এবং আগামী প্রজন্ম এক দেউলিয়া রাষ্ট্র পাবে এই দেশে নতুন নেতৃত্ব দরকার। সৎ নেতৃত্ব।দায়বদ্ধ নেতৃত্ব। দূরদর্শী নেতৃত্ব।যে নেতৃত্ব-দুর্নীতি বন্ধ করবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার আনবে মেগা প্রকল্পের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং দেশকে ঋণের দাসত্ব থেকে মুক্ত করবে।
এখনই সিদ্ধান্তের সময়-চুপ থাকলে দেশ বাঁচবে না
আজ প্রশ্ন একটাই-এই ভয়াবহ ঋণের দায় কার?
যে শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতার লোভে দেশকে ঋণের ফাঁদে ঢুকিয়েছে,যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্নীতিকে উন্নয়ন হিসেবে সাজিয়েছে,যে নেতৃত্ব জনগণের জবাবদিহিতাকে ধ্বংস করেছে-এই দায় তাদেরই।কিন্তু এই বোঝা বহন করবে কে?
জনগণ।আমাদের সন্তানরা।আমাদের ভবিষ্যৎ। এখন চোখ খোলার সময়-এখন প্রশ্ন করার সময়-এখন পরিবর্তনের সময়।একজন সাংবাদিক,একজন নাগরিক,একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে আমি বলছি-এ দেশ বদলাতে হবে। এই পথ বদলানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক,নবজাগরণ
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com




