মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
পোশাক পরিবর্তন-নাকি রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের সূচনা?বাংলাদেশ পুলিশ নতুন পোশাক পেয়েছে। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।কেউ বলছে“চমৎকার-স্মার্ট।”কেউ বলছে-“নতুন পোশাক দেখে লাভ কি?”আর নাগরিক সমাজের সরাসরি ভাষ্য-“নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হলে শুধু পোশাক নয়-পুলিশের মন,চরিত্র,দায়িত্ববোধ,নৈতিকতা সবকিছু বদলাতে হবে।”
কারণ আমরা মাত্রই পেরিয়ে এসেছি এক অন্ধকার সময়-এক সময় যেখানে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের বিরুদ্ধে।আজ,নতুন পোশাককে কেন্দ্র করে প্রকৃত প্রশ্ন-এটি কি বাহ্যিক সাজসজ্জা,নাকি পুলিশকে নতুন করে জনগণের সেবক হিসেবে পুনর্গঠনের সূচনা?এই বিশাল লেখায় সেই প্রশ্নের গভীর,তথ্যসমৃদ্ধ,বিপ্লবী বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশের পুলিশ-উপনিবেশিক আইন থেকে দমনযন্ত্রে পরিণত হওয়ার ইতিহাস ব্রিটিশ আমলের পুলিশ আইন (১৮৬১)এই আইন পুলিশকে দেয় নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা-
সেবা নয়, দমন।এর উদ্দেশ্য ছিল নাগরিক সুরক্ষা নয়; উপনিবেশ রক্ষা।পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক ব্যবহারের সূচনা স্বাধীনতার পরও কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি বহু সরকার ক্ষমতায় গিয়ে পুলিশকে নিজের দলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। গত ১৫ বছরে পুলিশি অবক্ষয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় আমরা দেখেছি-বিরোধী দল দমন সাংবাদিক এবং ছাত্রদের ওপর নির্যাতন রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যাওয়া ভোট ডাকাতির প্রধান বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যার বর্ধিত অভিযোগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শত শত ঘটনা থানায় হয়রানি ও ঘুষের সংস্কৃতি এ কারণেই জনগণের মনে প্রশ্ন“পোশাক পাল্টালে কি এই চরিত্র বদলাবে?”
নতুন পোশাক-এটি কি বার্তা দেয় নাকি শুধু বাহ্যিক সাজসজ্জা?নতুন পোশাক নিঃসন্দেহে আধুনিক, মানানসই, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে আপডেট।কিন্তু পৃথিবীর কোথাও শুধুমাত্র পোশাক পাল্টে পুলিশ পরিবর্তিত হয়নি।বিশ্বে যেসব দেশে প্রকৃত পুলিশ সংস্কার হয়েছে-জাপান-কমিউনিটি পুলিশিং (কোবান মডেল)ফিনল্যান্ড-অ-হিংস্র পুলিশ নরওয়ে-উচ্চমানের নৈতিক প্রশিক্ষণ সিঙ্গাপুর-দুর্নীতিমুক্ত কঠোর শৃঙ্খলাএই দেশগুলো বুঝেছে-পোশাক নয়, চরিত্র পরিবর্তনই আসল।বাহ্যিকতা নয়, নৈতিকতা ও জবাবদিহিই মূল।বাংলাদেশে নতুন পোশাক একটি ভালো পদক্ষেপ-কিন্তু যদি এটিই সংস্কারের শেষ হয়,তাহলে এটি হবে জনগণের টাকায় ব্যয়বহুল সাজসজ্জা ছাড়া কিছু নয়।
জনগণ পুলিশের বেতন দেয়-তাই পুলিশ জনগণের,কোনো দলের নয় এই সত্যটি যতবার বলা হয় ততোবারই পুলিশের ভেতরে অস্বস্তি তৈরি হয়-কারণ পুলিশকে বছরের পর বছর শেখানো হয়েছে-“দলের নির্দেশই আইন।”“ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থই রাষ্ট্রের স্বার্থ।”কিন্তু বাস্তবতা হলো-রাষ্ট্র চলে করদাতার টাকায়।পুলিশ সেই রাষ্ট্রের কর্মচারী। অতএব, পুলিশ জনগণের সেবক-কখনোই কোনো দলের নয়।দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে পুলিশকে দলীয় রক্ষী বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনরা যে ক্ষতি করেছে-এটি শুধু দেশের নয়, পুলিশেরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।জনগণ আজ নতুন বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্পষ্টভাবে বলছে-“আমরা নতুন পোশাক চাই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি চাই নতুন চরিত্র।”
১৫ বছরের বিতর্কিত ভূমিকা-যা আজ পুলিশের জন্য কলঙ্ক
গত এক যুগে পুলিশের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে,তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত- ভিন্নমত দমন
বড় কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ হলেই পুলিশ ট্রাক, কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেট নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।সাংবাদিক নির্যাতন ক্যামেরা ভাঙা, ভিডিও ডিলিট করতে বাধ্য করা, আইনের অপপ্রয়োগ।ভোট ডাকাতি রাতের ভোট, সিলমারা নির্বাচন-পুলিশ ছিল প্রধান অপারেটর।গুম ও রাতের আঁধারে তল্লাশি শত শত পরিবার আজও জানে না তাদের সন্তান কোথায় রাজনৈতিক মামলার পাহাড় নিরপেক্ষতা সম্পূর্ণ ধ্বংস।এই ইতিহাসকে শুধুমাত্র নতুন পোশাক দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না।এই ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সত্যিকারের সংস্কারের মধ্য দিয়ে।
নতুন বাংলাদেশে পুলিশের জন্য ১৫টি বড় সংস্কার জরুরি
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা পুলিশকে প্রধানমন্ত্রী বা কোনো মন্ত্রী নয়-আইন ও সংবিধান পরিচালনা করবে।
Police Service Commission গঠন যাতে পদোন্নতি, নিয়োগ, বদলি-সবকিছু রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়।স্বাধীন Internal Investigation Board পুলিশের অপরাধ পুলিশ তদন্ত করবে-এই অস্বাভাবিকতা দূর করা।বডিক্যাম বাধ্যতামূলক করা সব অপারেশনে বডিক্যাম-দুর্নীতি ও হয়রানি কমবে। থানাকে ভয়ের জায়গা নয়-মানুষের জায়গা বানানো“ওপেন পুলিশ স্টেশন” মডেল চালু।
গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদে মানবাধিকার নিশ্চিত করা
নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী-সবার জন্য সুরক্ষিত পুলিশিং ব্যবস্থা
কমিউনিটি পুলিশিং পুনরুজ্জীবন থানাভিত্তিক জবাবদিহি কমিটি থানার কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করবে নাগরিক প্রতিনিধিরা।বদলি-পদোন্নতি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশের শিক্ষাক্রমে যোগ হবে-মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, মানবাধিকার,আচরণবিজ্ঞান মাদক-হয়রানি-ঘুষের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা আইনে স্পষ্ট নিশ্চয়তা স্মার্ট পুলিশিং-ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনকালে পুলিশ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও বিচারিক নিয়ন্ত্রণাধীন এসব বাস্তবায়ন ছাড়া নতুন বাংলাদেশে নতুন পুলিশ অসম্ভব।
নতুন পোশাক-একটি মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের সুযোগ
পোশাক একটি প্রতীক।প্রতীকের শক্তি আছে।কিন্তু প্রতীক অর্থবহ তখনই, যখন তা বাস্তব পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়।যদি এই পোশাক পরিবর্তন হয় নিম্নলিখিত প্রতিশ্রুতির সঙ্গে-“আমরা জনগণের সেবক।আমরা কোনো দলের বাহিনী নই।আমরা রাষ্ট্রের আইন রক্ষা করব।আমরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি।”তাহলে এটি হবে নতুন বাংলাদেশের প্রথম বড় সংস্কার কিন্তু যদি এটি হয়-কেবল “ইমেজ পরিবর্তন”-তাহলে এটি হবে বিভ্রান্তি এবং অপচয়।
পুলিশের মন পরিবর্তন হলে কী লাভ হবে?
জনগণের আস্থা ফিরে আসবে অপরাধ কমে যাবে
বিনিয়োগ বাড়বে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে
আন্তর্জাতিক মান বজায় থাকবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে রাষ্ট্র এবং জনগণের মাঝে আস্থা তৈরি হবে নতুন বাংলাদেশ বাস্তব রূপ পাবে অর্থাৎ পুলিশ বদলালে পুরো রাষ্ট্র বদলে যায়।
অতীতের ভুলগুলো ডাস্টবিনে ফেলতে হবে-জাতি নতুন করে শপথ নিতে চায়-জনগণ বলছে-“পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো নির্যাতন, পুরনো দলীয়করণ, পুরনো অবিচারও ডাস্টবিনে ফেলো।”এ কথার পেছনে কারণ আছে-নারীর আর্তনাদ,শিশুর কান্না,বাবা-ছেলের নিখোঁজ হওয়া,সাংবাদিকদের চোখে আঘাত-এসব ভুলে যাওয়ার মতো নয়।কিন্তু ভুলকে স্বীকার করলে তারপর যদি নতুন শুরু হয়-জাতি তা গ্রহণ করবে।
কারণ নতুন বাংলাদেশ মানেই নতুন আস্থা,নতুন পথ।
পোশাক বদলেছে-এবার বদলাক পুলিশি চরিত্র ও রাষ্ট্রনৈতিকতা নতুন সার্জেন্টের ইউনিফর্ম,নতুন কনস্টেবলের জামা-এগুলো সুন্দর।কিন্তু দৃশ্যমান পরিবর্তন তখনই শক্তিশালী হয় যখন এর পেছনে থাকে-নতুন নৈতিকতা নতুন মন নতুন দায়িত্ব নতুন জবাবদিহি নতুন রাষ্ট্রচিন্তা এবং সর্বোপরি-জনগণের প্রতি নতুন শ্রদ্ধা।নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পুলিশ হবে-দলের নয়, জনগণের পুলিশ।ভয়ের নয়, ভরসার জায়গা।দমন নয়, সুরক্ষার শক্তি।ক্ষমতার নয়, সংবিধান ও ন্যায়ের রক্ষক।পোশাক বদলেছে-এবার বদলাক পুলিশ।তাহলেই বদলাবে বাংলাদেশ।তাহলেই নতুন বাংলাদেশ পূর্ণতা পাবে।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক,নবজাগরণ




