অযোধ্যার দুর্গপত্নী:ইতিহাসের অন্তরাল থেকে হায়দারজান বেগমের বিপ্লবী উত্তরাধিকার

এমএম তোহা:
আমরা যখন ইতিহাস লিখি, সাধারণত পুরুষদের নামই ঘুরেফিরে আসে-নবাব, বাদশাহ,জেনারেল,দরবারি,রাজপুত্র। অথচ ইতিহাসের গভীর গহ্বরে, বহু শক্তিধর নারী থেকে গেছেন উপেক্ষিত,তাদের অস্তিত্ব চাপা পড়ে গেছে পুরুষতান্ত্রিক কলমের কালিতে। আজ তেমনি এক বিস্মৃত অথচ ক্ষমতাধর নারীর কথা বলবো-হায়দারজান বেগম, অযোধ্যার প্রভাবশালী নবাবী নারী, যিনি শুধু ক্ষমতার ছায়ায় ছিলেন না,বরং স্বয়ং ক্ষমতার ছাদনাতলায় দাঁড়িয়ে সময়কে চালনা করেছেন।

কে ছিলেন হায়দারজান?
হায়দারজান ছিলেন নবাব গাজীউদ্দীন হায়দারের স্ত্রী এবং অযোধ্যার শাসক পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ নারী সদস্য। মোঘল সাম্রাজ্যের অস্তমিত সূর্য যখন উপমহাদেশের আকাশে রক্তাক্ত রঙ ছড়াচ্ছিল, তখন অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে হায়দারজান নীরবে কিন্তু দৃঢ় হাতে রচনা করছিলেন নারীর নেতৃত্বের এক অচেনা অধ্যায়।

তিনি ছিলেন কূটনৈতিক,প্রশাসক এবং নির্মাতা-একাধারে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল কারিগরি শিল্প, স্থাপত্য এবং ধর্মীয় পরম্পরার বহু নিদর্শন। তার নির্মিত‘সতী খানা’ এবং অন্যান্য কাঠামো আজও অযোধ্যার স্থাপত্য ইতিহাসে এক অনন্য সাক্ষ্যবাহী।

নারীর ক্ষমতা মানেই কি নীরবতা?
না। হায়দারজান ছিলেন সেই নারী,যিনি দরবারের বাইরে দাঁড়িয়ে শুধুই পতিব্রতা রমণী ছিলেন না-তিনি নিজেই ছিলেন রাজনীতি। একটি সময় তিনি অযোধ্যার “দ্য ফার্স্ট লেডি” নন, ছিলেন দ্য ডি ফ্যাক্টো রুলার। বলা হয়ে থাকে,ব্রিটিশ রেসিডেন্টরাও তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছু করতো না।

কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি জানত,নারী যখন আত্মপ্রত্যয়ী হয়,তখনই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ইতিহাস তাই তাকে মুছে দিতে চেষ্টা করেছে। ভারতের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে, কিংবা উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে হায়দারজানের নাম নেই-কারণ তিনি ছিলেন ক্ষমতায় থাকা নারীর প্রতীক,যা পুরুষতন্ত্রের জন্য হুমকি।

হায়দারজান বনাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ
ব্রিটিশরা যখন ধূর্তভাবে মুসলিম শাসকদের দুর্বল করে তাদের জমি ও কর্তৃত্ব কেড়ে নিচ্ছিল, তখন হায়দারজান দাঁড়িয়েছিলেন রক্ষণশীল অভিজাত সমাজ আর ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের মাঝখানে। তিনি জানতেন, রাজনীতি মানে শুধু তরবারির ঝনঝনানি নয়-তা হচ্ছে গোপন অর্থনীতি, ভূমি-নীতির প্রতিরোধ, দরবারি কূটনীতি এবং ধর্মীয় ভাবাবেগকে নিজেদের দিকে টেনে আনার লড়াই।

তাঁর একক সিদ্ধান্তেই বহু দরবারি অপসারিত হয়েছেন, আবার অনেকে পদোন্নতি পেয়েছেন। হায়দারজান বুঝতেন ক্ষমতার প্রকৃত উৎস, এবং এই জ্ঞানই তাকে একদা ভয়ংকর ব্রিটিশ শাসকদের জন্য বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ করে তুলেছিল।

নারীর ইতিহাস মানে শুধু ভোগ নয়, ভাঙচুরও
হায়দারজানের মতো নারীরা আমাদের স্মরণে থাকলে হয়তো ইতিহাসের চেহারাটা বদলে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের পাঠ্যবইয়ে “রানী” মানে শুধু রানী ভিক্টোরিয়া, “প্রতাপ” মানে শুধু পুরুষের, আর “উন্নয়ন” মানে ব্রিটিশদের অবদান!

আমরা ভুলে যাই-এককালে উপমহাদেশের দুর্গরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এক নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন,যিনি বিশ্বাস করতেন, “ক্ষমতা কারো দয়ার বস্তু নয়-ক্ষমতা আদায় করতে হয়, ধরে রাখতে হয়, প্রয়োজনে নির্মম হতে হয়।”

আজকের দিনে হায়দারজান কেন জরুরি?
আজ যখন নারী নেত্রীদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়,যখন রাজনীতি আর ধর্মীয় দখলদারিত্বে নারীর অংশগ্রহণ হ্রাস পায়, তখন হায়দারজান আমাদের শেখান-নারী শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, ক্ষমতার আসনেও বসে।

আজ যখন ইতিহাসকে নতুন চোখে লেখার ডাক উঠেছে-“ইতিহাস মানে কেবল যুদ্ধ নয়, নারীও ইতিহাসের নির্মাতা” -তখন হায়দারজানকে স্মরণ করা এক রকম বিপ্লব।নারী ক্ষমতায়নের আসল রূপটা এই নারীর জীবন থেকেই উঠে আসতে পারে-আত্মবিশ্বাস, প্রশাসনিক দক্ষতা,সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং দুঃসাহসিকতা।