মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক গভীর সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। দীর্ঘদিনের দুঃশাসন, বিদেশি প্রভুত্বের কাছে নতজানু নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণ আজ সর্বত্র প্রশ্নবিদ্ধ। এই সময়ে যে ব্যক্তি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন, তিনি গণঅধিকার পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর। নুর এমন এক নেতা, যিনি কারো দালালী করেন না, ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় টিকে থাকা শাসনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বাংলার মাটি ও মানুষের সার্বভৌম রাজনীতির কথা বলেন। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ভারতের দোসররা তাঁকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে।
শেখ হাসিনা ও ভারতের ভূরাজনীতি: বন্দী নেতৃত্বের কাহিনি
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন একদিকে বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনার শিকার। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে তাঁকে ঘিরে ভারতের ভূরাজনৈতিক ছায়া স্পষ্ট হতে শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করতে ভারতের আশীর্বাদে শেখ হাসিনা উঠে আসেন। কিন্তু এর ফল হয়েছিল ভয়াবহ-বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাধীনতার চেতনা নয়, বরং ভারতীয় স্বার্থরক্ষার উপকরণে পরিণত হয়।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে শেখ হাসিনার সরকারকে ভারত তার আঞ্চলিক নিরাপত্তা কৌশলের কেন্দ্রে বসিয়েছে। ভারতের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি-ট্রানজিট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের নির্ভরশীলতা-সবই বাংলাদেশের কৌশলগত স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। তিস্তা চুক্তি, রোহিঙ্গা চুক্তি, বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তি-সবই দেশের স্বার্থের জন্য নয়, বরং ভারতীয় প্রভাব বিস্তারের জন্য।
ভারতের আধিপত্যের কৌশল: সার্বভৌমত্বের গলা টিপে ধরা
বাংলাদেশের উপর ভারতের আধিপত্য কোনো একক ঘটনা নয়, বরং বহুমাত্রিক কৌশল।
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ভারতীয় প্রভাব-বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের একতরফা নির্বাচন-স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক ভোটকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
অর্থনৈতিক দাসত্ব: বিদ্যুৎ, গ্যাস ও বন্দর খাত ভারতীয় কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের কৃষি ও শিল্প খাত প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিল না।
সামরিক নির্ভরশীলতা: যৌথ মহড়া, চুক্তি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্রয়-সবই ভারতের প্রভাবকে স্থিতিশীল করেছে।
সাংস্কৃতিক দখলদারিত্ব: সিনেমা, টেলিভিশন, সঙ্গীত ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভারতের নরম শক্তি দেশের মানসিকতা প্রভাবিত করছে।এইভাবে ভারতের কৌশল বাংলাদেশকে একটি আধা-উপনিবেশে পরিণত করেছে।
জুলাই বিপ্লব: ৫ আগস্ট ২০২৪
৫ আগস্ট ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ভারতে পালিয়ে যান। এই গণঅভ্যুত্থান দেশের গণতান্ত্রিক, সার্বভৌম এবং স্বাধীনচেতা রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস। আন্দোলনের সময় প্রায় ১০ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে জনসাধারণের ঐক্য প্রদর্শন করে এবং সরকারের ক্ষমতাশালী দমননীতি প্রতিরোধ করে। বিপ্লবের ফলে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৩০০ জন ছাত্র-নেতা ও নাগরিক আহত হন।
নুর: দ্বিতীয় ভাসানী এবং স্বাধীন নেতৃত্ব
মাওলানা ভাসানী যেমন ভারতের কৌশলগত আধিপত্যের প্রথম চ্যালেঞ্জার ছিলেন, তেমনি নুর আজকের বাংলাদেশে সেই ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা, কারো দালালী না করা নেতা। তিনি ভারতের দালালীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, দেশের স্বার্থ ও জনগণের অধিকারকে সর্বোচ্চ স্থান দেন।
সম্প্রতি, নুরকে রক্তাক্ত করার সময় সেনাবাহিনীর লোকেরা প্রকাশ্যে বলেছে-“জুলাই ভরে দিবো”, যা স্পষ্টভাবে হুমকি এবং ভয় সৃষ্টি করার কৌশল। এই হুমকি কেবল নুরকে নিশানা বানানোর জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের সকল স্বাধীনচেতা নেতার ওপর আঘাতের বার্তা। এটি দেখায়, বিদেশি শক্তি ও দেশীয় দোসররা গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সার্বভৌম নেতৃত্বকে নির্মূল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
হত্যাচেষ্টা: গণতন্ত্রের ওপর আঘাত
নুরের ওপর হামলা নিছক রাজনৈতিক সহিংসতা নয়। এটি পরীক্ষামূলক হামলা, যাতে দেখা যায়-ভবিষ্যতে অন্য স্বাধীন নেতা বা দলকে লক্ষ্য করে একই ধরনের আঘাত চালানো যায় কি না। এতে প্রকাশ পায়, যে শক্তি ভারতের প্রভাব বিস্তার চায়, তা স্বাধীন নেতৃত্ব সহ্য করতে পারবে না। নুরকে রক্তাক্ত করা মানে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।
সর্বদলীয় ঐক্য ও পাঁচ দফা কর্মসূচি-
নুরের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিএনপি সহ ২২টি দল একত্রিত হয়। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, সভাপতিত্ব করেন রাশেদ খান। ঘোষণা করা হয় পাঁচ দফা কর্মসূচি-যা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নতুন দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। ঐক্য শুধুই রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, এটি জনগণকে দেখিয়ে দেয় যে সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে সব রাজনৈতিক শক্তিকে একযোগে কাজ করতে হবে।
ভবিষ্যতের করণীয়-
১. জনগণের ঐক্য: রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে জাতীয় স্বার্থে এক হতে হবে।
২. ভারতের আধিপত্য প্রতিরোধ: অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে হবে।
৩. গণতন্ত্রের পুনর্নির্মাণ: স্বচ্ছ নির্বাচন ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. স্বাধীন নেতৃত্বের সুরক্ষা: ভিপি নুরসহ স্বাধীনচেতা নেতাদের জীবন রক্ষায় জনগণকে সরাসরি দায়িত্ব নিতে হবে।
নুর মানে নতুন বাংলাদেশ:
নুরের ওপর আঘাত মানে শুধু একজন ব্যক্তির ওপর হামলা নয়; এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। তিনি কারো দালাল নন, ভারতের তাঁবেদার নন; বরং তিনি বাংলার প্রকৃত সন্তান, প্রকৃত সৈনিক। তাঁর রক্ত আমাদের স্বাধীনতার নতুন শপথ। ইতিহাস সাক্ষী—বাংলার মাটি দাসত্ব মেনে নেবে না।
আজ আমাদের দায়িত্ব-নুরের লড়াইকে জনগণের সংগ্রামে রূপান্তরিত করা,ভারতীয় ফ্যাসিবাদী প্রভাব ও দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলন গড়ে তোলা। নুর বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক,নবজাগরণ