স্বাধীনতার ৫৪ বছরে কেউ পারেনি-বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করে ইতিহাস গড়লেন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫-বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের এক মৌলিক মাইলফলক

মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ইতিহাসে রাষ্ট্রশক্তির তিন অঙ্গ-বিধান, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার দাবি ছিল একটি মৌলিক ও প্রায়-অপূরণীয় অঙ্গীকার।সংবিধান লিখে রাখা হয়েছিল, আদালত স্বাধীন হবে; হাইকোর্ট অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান করবে; ন্যায়বিচার হবে প্রভাবমুক্ত।কিন্তু বাস্তবতা?বিচার বিভাগ ছিল নির্বাহী বিভাগের প্রশাসনিক শাখা হিসেবে কার্যত আবদ্ধ।যেখানে বদলি, পদায়ন,

প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে বাজেট-সবকিছুই নির্ভর করত আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক সরকারের মর্জির ওপর।ফলে বহু বিচারক মনে মনে বলতেন-সংবিধান স্বাধীনতা দেয়। কিন্তু প্রশাসন সেই স্বাধীনতাকে বন্দি করে রাখে। কিন্তু যেটি ৫৪ বছরে কেউ পারেনি-সেটি করলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।কারণ, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি হওয়া মানে-বিচার বিভাগ প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাহী বিভাগের বাইরে নিজস্ব স্বাধীন প্রশাসনিক সত্তা পেল।এটি শুধু একটি প্রশাসনিক সংস্কার নয়-এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ইতিহাসে একটি প্রতিষ্ঠানগত বিপ্লব।

স্বাধীনতার পর থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: কাগজে ছিল, বাস্তবে ছিল না ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা স্পষ্ট ছিল।১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-হাইকোর্ট বিভাগ অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবে।কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়-যে সচিবালয়ের মাধ্যমে আদালতের প্রশাসন

চলবে, সেটি ছিল সরাসরি নির্বাহী বিভাগের অধীনে।
অর্থাৎ-বাজেট দিত নির্বাহী বিভাগ নিয়োগ ও বদলি নির্ধারণ করত নির্বাহী বিভাগ আদালতের নিজস্ব প্রশাসন পরিচালনা করত নির্বাহী বিভাগ বিচারকদের স্বাধীনতার ওপর ছিল পরোক্ষ প্রভাবের চাপ ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাস্তবায়িত ছিল না। এটি যেন-সংবিধানে লেখা ছিল ‘নির্বাচনের অধিকার’, কিন্তু ভোট কেন্দ্র দখল করত কেউ অন্যজন।

২০১০ সালে নিম্ন আদালত পৃথক হলেও,বিচার বিভাগের মূল প্রশাসন ছিল আগের জায়গায় ২০০৭-২০১০ সংস্কারের সময় নিম্ন আদালতকে প্রশাসনিকভাবে পৃথক করা হয়েছিল।কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি থেকে গিয়েছিল অমীমাংসিত-সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয়ের প্রশ্ন।যে সচিবালয় ছাড়া-বিচার বিভাগ কখনো নিজের নিয়োগ-বদলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না প্রশাসন নিজের হাতে নিতে পারবে না আদালত নিজের বাজেট নিজে তৈরি করতে

পারবে না অর্থাৎ বিচার বিভাগ তখনও অধিকারহীন স্বাধীনতার মধ্যে ছিল। প্রধান বিচারপতির ঐতিহাসিক চিঠি ২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি এক সাহসী এবং যুগান্তকারী প্রস্তাব পাঠান আইন মন্ত্রণালয়ে।যেখানে তিনটি মূল দাবি করা হয়-বিচার বিভাগীয় স্বাধীন সচিবালয় গঠন নতুন অর্গানোগ্রাম অনুমোদন রুলস অব বিজনেস সংস্কার করে বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি এই চিঠিটিই ছিল স্বাধীনতার ৫৪ বছরের বিচার বিভাগ পুনর্গঠনের ব্লুপ্রিন্ট।

ড. ইউনূস সরকার এসে করলেন অসম্ভবকে সম্ভব
২০ নভেম্বর ২০২৫-অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এই খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।৩০নভেম্বর-রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি হয়।এই সিদ্ধান্তটির রাজনৈতিক সাহস, নৈতিক দৃঢ়তা এবং প্রশাসনিক দূরদৃষ্টি ছিল অভূতপূর্ব।কারণ-যে কাজটি রাজনৈতিক সরকারগুলো কখনো সাহস করেনি,অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটি করে দেখাল।দুর্বল রাজনৈতিক সরকারের কাছে আদালতের স্বাধীনতা ছিল ‘ক্ষমতা হারানোর ভয়’।কিন্তু একটি নিরপেক্ষ, নাগরিক-নির্ভর, মানবিক অন্তর্বর্তী সরকার সে ভয়কে পাত্তা দেয়নি।

কেন এই সংস্কারকে “রাষ্ট্র পুনর্গঠনের” মাইলফলক বলা হচ্ছে?বিচার বিভাগের পূর্ণ প্রশাসনিক স্বাধীনতা এখন আদালতের নিজস্ব সচিবালয়-নিয়োগ বদলি বাজেট পদোন্নতি আদালত পরিচালনার নিয়ম সবকিছু দেখবে।নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ শেষ বিচারকদের ওপর পরোক্ষ চাপ, প্রভাব, ভীতি-এই সংস্কারের পর কার্যত শেষ ন্যায়বিচার প্রাপ্তির কাঠামোগত উন্নয়নস্বাধীন প্রশাসন মানে-রায়ের গতি বাড়বে, জট কমবে, বিচার ব্যবস্থার মান উন্নত হবে। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের পূর্ণ বাস্তবায়ন এটি প্রথমবার। গণতান্ত্রিক চেক অ্যান্ড ব্যালান্স শক্তিশালী হবে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার ওপর একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকবে পেশাগত এবং নৈতিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় ভিত্তি স্থাপন যে সময়ে দেশে নতুন রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার পথচলা শুরু হয়েছে,যে সময়ে রাষ্ট্রের নৈতিক পুনরুদ্ধার চলছে-ঠিক সেই সময়েই ড.মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর নেতৃত্বের নৈতিক বৈধতা আরও শক্তিশালী করলেন।তিনি প্রমাণ করলেন-রাষ্ট্র পরিচালনা মানে দলীয় স্বার্থ নয়;রাষ্ট্র পরিচালনা মানে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিষ্ঠান গঠন। এই সংস্কার সাধারণ মানুষের জন্য কী পরিবর্তন আনবে?রায় দ্রুত হবে আদালতের সেবা হবে সহজ, আধুনিক বিচারকদের ওপর রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক চাপ কমবে দুর্নীতি কমবে বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে মানুষের ন্যায়বিচারের আস্থা ফিরে আসবে

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ৫৪ বছরে এত বড় প্রশাসনিক স্বাধীনতা কখনো পায়নি।বিচার বিভাগের স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা-রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক নতুন অধ্যায়এটি শুধু একটি সংস্কার নয়;এটি জাতির ভবিষ্যৎ ন্যায়বিচারের কাঠামো পুনর্গঠন।এটি স্বাধীনতার প্রকৃত প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়ন।এবং এ অর্জনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন-প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-নবজাগরণ
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com