নবজাগরণ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানার নাম। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাংবাদিককে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছিলেন। সাংবাদিকের অপরাধ ছিল-সত্য প্রকাশ। আজ সেই সুলতানা কারাগারে-এ যেন বিচার ও জনগণের সত্য জানার অধিকার একসাথে বিজয়ী হলো।
কিন্তু এই ঘটনাকে কেবল একজন কর্মকর্তার পতন হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি আসলে রাষ্ট্রের ভেতরে ক্ষমতার ভারসাম্য ও গণমাধ্যমের মর্যাদা রক্ষার লড়াই।
রাষ্ট্রের চার স্তম্ভ: গণতন্ত্রের কাঠামো
একটি রাষ্ট্র কেবল আইনসভা বা প্রশাসনের শক্তিতে টিকে থাকে না। গণতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার জন্য চারটি স্তম্ভ অপরিহার্য-
১. বিচার বিভাগ-ন্যায়বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল।
২. আইনসভা-জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি, যারা আইন প্রণয়ন করেন।
৩. নির্বাহী বিভাগ-সেই আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন।
৪. গণমাধ্যম/সাংবাদিকতা-অন্য তিন স্তম্ভের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে জনগণকে জানানো ও দায়বদ্ধ রাখা।
প্রথম তিনটি স্তম্ভ রাষ্ট্রের ভেতরে, কিন্তু গণমাধ্যম বাইরে থেকে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে সাংবাদিকতা হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকতাকে দুর্বল করলে বাকি তিনটি স্তম্ভ অকার্যকর হয়ে পড়ে।
কুড়িগ্রামের ঘটনা: প্রশাসনিক অহংকারের নগ্ন প্রকাশ
সাবেক ডিসি সুলতানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চালিয়েছিলেন, তা কেবল একজন ব্যক্তিকে অপমান করা নয়-বরং জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে পদদলিত করা।
কুড়িগ্রামের সাংবাদিককে উলঙ্গ করে নির্যাতন করে যেভাবে জেলে গেলেন সাবেক ডিসি সুলতানা।
প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও নানা অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান করায় ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের বাসায় অভিযান চালানো হয়। তাকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকিসহ ডিসি অফিসে এনে নির্মম নির্যাতন করেন জেলা প্রশাসনের তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা। এরপর অধূমপায়ী আরিফের বিরুদ্ধে আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে ওই রাতেই এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়।
কারামুক্ত হয়ে এ ঘটনায় সাংবাদিক আরিফুল হক রিগান জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলা করেন। ৫ বছর ধরে এই মামলা চলছে। সম্প্রতি সাবেক জেলা প্রশাসক হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেও স্থায়ী জামিন পাওয়ার জন্য মঙ্গলবার দুপুরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসেন। আদালত তাকে জেলে পাঠায়।
এটি তিনটি সত্য প্রকাশ করেছে:প্রশাসন প্রায়শই নিজেকে রাষ্ট্রের মালিক ভেবে বসে। সাংবাদিককে শত্রু হিসেবে দেখা প্রশাসনিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থাকলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। কিন্তু সুলতানার কারাবরণ প্রমাণ করেছে-কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সাংবাদিকের কলমকে রক্তাক্ত করা যায়, কিন্তু নীরব করা যায় না।
সাংবাদিকতার ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা কেবল খবর পরিবেশনের কাজ নয়-এটি স্বাধীনতার লড়াইয়ের অংশ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা বিশ্বে জানাতে বিদেশি সাংবাদিকরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সাইমন ড্রিং, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস প্রমুখের প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করেছিল।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকরাই জনগণের চোখ-কান হয়ে কাজ করেছেন। সেনাশাসন, গুম, হত্যা-সবই তারা উন্মোচন করেছেন। সাম্প্রতিক কালে সাংবাদিকরা দুর্নীতি, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, মানবাধিকার লঙ্ঘন-সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
অতএব, সাংবাদিক নির্যাতন মানে জনগণের ইতিহাস, স্মৃতি ও ভবিষ্যৎকে একসাথে আক্রমণ করা।
পরিসংখ্যান: বাংলাদেশের সাংবাদিক নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র-বাংলাদেশে সাংবাদিকরা কতটা নিরাপদ? পরিসংখ্যান ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে-রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF) ২০২৪: বাংলাদেশ বিশ্বে ১৬৯তম স্থানে। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম খারাপ অবস্থা।
অধিকার (২০২৩): বছরে অন্তত ১৯০ জন সাংবাদিক হামলা, হুমকি বা মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি): ২০২২ সালে ৬৭% সাংবাদিক বলেছেন, তারা সংবাদ প্রকাশের সময় রাজনৈতিক চাপ বা প্রশাসনিক হুমকির মুখে পড়েন।
২০২০ সালে কুড়িগ্রামের ঘটনায় সাংবাদিক নির্যাতনের পাশাপাশি একাধিক জেলায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই বিচার হয়েছে।
এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে-সুলতানার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়;বরং রাষ্ট্রীয় দমননীতির অংশ।
সাম্প্রতিক উদাহরণ:
২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জে দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করায় এক সাংবাদিককে মারধর করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।
২০২৩ সালে খুলনায় প্রশাসনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।
২০২৪ সালে ঢাকায় নির্বাচনী অনিয়ম কাভার করতে গিয়ে সাংবাদিকরা পুলিশের হাতে হামলার শিকার হন।
অতএব, কুড়িগ্রামের ঘটনা স্রেফ একটি আইসবার্গ-তার নিচে লুকিয়ে আছে সাংবাদিক দমনের বিশাল সংস্কৃতি।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা: সাংবাদিক দমন মানেই পতনের সূচনা
যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন।
ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় গণমাধ্যম দমন তার রাজনৈতিক পতনের কারণ হয়।
মিশরে সাংবাদিক দমন আজও সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
শিক্ষা একটাই-সাংবাদিককে দমন মানে নিজেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া।
করণীয়: সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ
১. সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করতে হবে।
২. সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা আইন ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার।
৩. প্রশাসনিক প্রশিক্ষণে সাংবাদিকতার গুরুত্ব শেখানো বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মতপ্রকাশ রোধকারী সব কালাকানুন বাতিল করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সাংবাদিকদের জন্য সুরক্ষা তহবিল গঠন জরুরি।
সত্যের বিজয় অনিবার্য:আজ যখন সাবেক ডিসি সুলতানা কারাগারে, এটি কেবল একজন কর্মকর্তার পতন নয়-এটি সত্য ও সাংবাদিকতার বিজয়। সাংবাদিক নির্যাতন মানে জনগণের কণ্ঠরোধ। আর জনগণ যদি নীরব থাকে, তবে রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-সত্যের কণ্ঠ কোনোদিন স্তব্ধ হয় না।
অতএব, জনগণকে মনে রাখতে হবে: সাংবাদিকের নিরাপত্তা মানেই গণতন্ত্রের নিরাপত্তা। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা মানেই জনগণের স্বাধীনতা। আজকের এই ঘটনা আমাদের নতুন করে আশ্বস্ত করে-যত ক্ষমতাশালীই হোক, অন্যায়ের পতন অনিবার্য; সত্যের কলমই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক
নবজাগরণ
শেয়ার করুন অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com