মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
বিচারের পাল্লা কোথায় হেলে? ফয়সাল করিমের জামিন, আদালত ও ‘মামলা-বাণিজ্য’প্রশ্ন ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ-এই নামটি আজ কেবল একটি হামলার অভিযুক্ত নয়;এটি বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সমতার প্রশ্নে একটি পরীক্ষাকেস।আদালতের নথি অনুযায়ী,২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির সময় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন ফয়সাল করিম মাসুদ। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়-এটি ছিল স্পষ্ট ফৌজদারি অপরাধ,রাজনৈতিক বক্তব্য নয়।
পরবর্তীতে ফয়সাল করিমের পক্ষে এডভোকেট কায়সার কামাল ও এডভোকেট মাহফুজুর রহমান হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি,হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি এসকে তাহসিন আলী-এর বেঞ্চ তাকে ৬ মাসের জামিন প্রদান করেন। লক্ষণীয় যে, ওই জামিন আদেশের পর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি-অস্বাভাবিক দ্রুততায়-আদেশটি আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।এরপর ১২ আগস্ট, জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করলে বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ সুমন–এর বেঞ্চ নতুন করে এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।
প্রশ্নগুলো তাই আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে-
অস্ত্রসহ ডাকাতির সময় ধরা পড়া একজন অভিযুক্ত কীভাবে ধারাবাহিকভাবে জামিন পান?এই প্রক্রিয়ায় কি রাজনৈতিক পরিচয় বা প্রভাব ভূমিকা রেখেছে?কোন রাজনৈতিক ধারার আইনজীবীরা কীভাবে এসব মামলায় সক্রিয়-এটি কি নিছক আইনি তৎপরতা,নাকি ‘মামলা-বাণিজ্য’?এখানে অভিযোগ নয়-এখানে স্বাধীন তদন্তের দাবি।কারণ বিচার যদি সমান না হয়,রাষ্ট্রের বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।আর জুলাই বিপ্লব কোনো প্রশ্নবিদ্ধ রাষ্ট্র গড়ার জন্য হয়নি।একদিকে-ওসমান হাদিহাসপাতালের বিছানায় জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে,তার পরিবার আতঙ্কে,তার গ্রামের বাড়ি লুটপাটের শিকার।অন্যদিকে-অস্ত্রসহ ধরা পড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি একের পর এক জামিনে বাইরে।এই বৈপরীত্য কি কাকতালীয়-নাকি ব্যবস্থাগত পক্ষপাতের প্রতিচ্ছবি?রাষ্ট্র যদি আজ জবাব না দেয়,ইতিহাস একদিন জবাব চাইবেই।
দিনের আলো ফোটার আগেই যেন প্রশ্নটা ছুরি হয়ে এসে দাঁড়ায়-“জুলাই বিপ্লব কাদের জন্য?”কারণ এ প্রশ্ন আবারও রক্ত দিয়ে লেখা হলো।দিনদুপুরে গুলি যখন ওসমান হাদির মাথার একপাশ থেকে অপর প্রান্তে ভেদ করে বেরিয়ে যায়, তখন শুধু একজন তরুণ আহত হয়নি-আঘাত লেগেছে জুলাই বিপ্লবের শপথে,আঘাত লেগেছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের রক্তাক্ত যাত্রাপথে,আঘাত লেগেছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতে।
ওসমান হাদি-এই নাম আজ কেবল একজন তরুণ নেতার পরিচয় নয়;এটি সত্য বলার সাহসের প্রতীক,অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অগ্নিশিখা,ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী দৃঢ় অবস্থানের নাম,স্বৈরশাসনবিরোধী যুবশক্তির প্রতিচ্ছবি,
এবং জুলাই বিপ্লবের সবচেয়ে অগ্নিঝরা চেতনা।এই হাদিকে গুলি করা মানে-জুলাই বিপ্লবের হৃদয়ে গুলি।এ কারণেই সহযোদ্ধা আসিফ ক্ষোভ,যন্ত্রণা আর রাগে প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে বলেন-“জুলাই যোদ্ধাদের রক্তে তৈরি রাষ্ট্রে আজ জুলাই যোদ্ধারাই সবচেয়ে অসুরক্ষিত!”এটি কোনো আবেগী বক্তব্য নয়-এটি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অভিযোগ।
ওসমান হাদি কে?কেন তিনি রাষ্ট্রশত্রুদের নিশানায়
ওসমান হাদি ছিলেন-ইনকিলাব মঞ্চের সভাপতি জুলাই বিপ্লবের সম্মুখসারির যোদ্ধা স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের কণ্ঠ ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী ধারালো সমালোচক তরুণ প্রজন্মের আশা ও আস্থার নাম তিনি যে কথা বলতেন-সেই কথা কাঁপিয়ে দিত দুর্নীতিবাজ মাফিয়া,দালাল রাজনীতি,প্রশাসনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা হাইব্রিড শত্রু,ভারতীয় গোয়েন্দাবান্ধব লবি,এবং জুলাই বিপ্লবের সুবিধাভোগী বিশ্বাসঘাতকদের।হাদির কণ্ঠ ছিল অস্বস্তিকর-কারণ তিনি সত্য বলতেন।আর সত্য সবসময় ক্ষমতালোভীদের জন্য বিষ।তাই হাদিকে হত্যার চেষ্টা হঠাৎ নয়-এটি একটি পরিকল্পিত,সমন্বিত,নীরব রাষ্ট্র-অভ্যন্তরীণ অপারেশন।
জুলাই বিপ্লবের সন্তানদের ভাগ্যে কেন এতো অবহেলা
যারা জুলাইয়ে গুলি খেয়েছে,যারা রাস্তায় রক্ত দিয়েছে,
যারা সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কারাগারে গেছে-আজ তাদের ঘরেই শত্রুর বসতি।জুলাই বিপ্লব থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান কারা?কিছু রাজনীতিবিদ কিছু উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিছু সিন্ডিকেট কিছু চাটুকার,দালাল,সুবিধাভোগী আর পুরনো স্বৈরাচারী কাঠামোর হাইব্রিড এলিটরা এই মহলগুলো আজ জুলাই যোদ্ধাদের দেখে ভয় পায়। কারণ জুলাই যোদ্ধারা প্রশ্ন তোলে।নাম ধরে দুর্নীতির কথা বলে।আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র বদলের কথা বলে।তাই প্রশাসনের ভেতরে বসেই তারাই আজ “জুলাই শত্রু”।
প্রশাসনের ভূমিকা:ব্যর্থতা,নাকি ইচ্ছাকৃত নীরবতা
আসিফের প্রশ্ন ভয়ঙ্করভাবে সোজা-“হাদিকে কে গুলি করলো-তা জানতে রাষ্ট্রের আর কোনো শক্তি নেই?”কিছু অস্বীকারযোগ্য সত্য-হাদির ওপর আগেও হুমকি ছিল প্রশাসন জানত ইনকিলাব মঞ্চ জানিয়েছিল তবু নিরাপত্তা দেওয়া হয়নি কেন?কার নির্দেশে?কার স্বার্থে?গুলির পর তদন্তে অদ্ভুত নীরবতা-এ কি কেবল অদক্ষতা,নাকি পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তা?রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী মহল চায়-জুলাই ফোর্স দুর্বল হয়ে যাক।কারণ জুলাই ফোর্সই পারে দুর্নীতি, সিন্ডিকেট
,দালাল নেটওয়ার্ক,ভারতীয় আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। এই কারণেই প্রশাসনের নীরবতা আজ রাষ্ট্রীয় অপরাধ।হাদির ওপর গুলি-একটি‘পাইলট প্রজেক্ট’এই গুলির বার্তা পরিষ্কার-“তোমরা কেউ নিরাপদ নও।”উদ্দেশ্য-তরুণদের ভয় দেখানো ইনকিলাব মঞ্চকে দুর্বল করা দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব ধ্বংস করা স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার কণ্ঠ রোধ করা এই গুলি কোনো ব্যক্তিকে নয়-ছোঁড়া হয়েছে জুলাই বিপ্লবের ভবিষ্যতের ওপর।
গুলির পরও থামেনি সন্ত্রাস: হাদির গ্রামের বাড়িতে মধ্যরাতে লুটপাট হাদির শরীর এখনো হাসপাতালের বিছানায়-তার আগেই আরেকটি বার্তা দেওয়া হলো।গতকাল গভীর রাতে ওসমান হাদির গ্রামের বাড়িতে দুর্বৃত্তরা চুরি ও লুটপাট চালায়।স্বর্ণালংকারসহ একাধিক মূল্যবান জিনিস লুট করে নিয়ে যায়।এটি কি সাধারণ চুরি?না।সময়টা কাকতালীয় নয়।টার্গেটটা এলোমেলো নয়।প্রথমে গুলি,তারপর পরিবারকে আতঙ্কিত করা,এরপর বাড়ি-ঘর অনিরাপদ করে তোলা-এটি পরিচিত রাজনৈতিক ভয়ভীতি প্রদর্শনের কৌশল।বার্তা একটাই-“চুপ না করলে শুধু তুমি নয়,তোমার পরিবারও নিরাপদ থাকবে না।”প্রশ্ন উঠছেই-একজন গুলিবিদ্ধ জুলাই যোদ্ধার পরিবারের নিরাপত্তা কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়?নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের অনিরাপদ রাখা হয়েছে?এই লুটপাট কেবল চুরি নয়-এটি মনস্তাত্ত্বিক সন্ত্রাস।
হাদির সর্বশেষ অবস্থা ও জাতির বিবেক
হাদি অস্ত্রোপচারের পর সংকটাপন্ন অবস্থা পার করছেন।
চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন।কিন্তু তার চেয়েও বড় ঝুঁকিতে-তার আন্দোলন,তার স্বপ্ন,এবং জুলাই বিপ্লবের ভবিষ্যৎ।হাদির রক্ত আজ নতুন প্রজন্মের বিবেককে জাগিয়ে তুলছে।রাষ্ট্রঘাতী‘জুলাই শত্রু’দের চার স্তর প্রশাসনের ভেতরের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত মহল ভারতীয় গোয়েন্দাবান্ধব লবি।পুরনো স্বৈরাচারী সুবিধাভোগী কাঠামো হাইব্রিড রাজনৈতিক এলিট এই চার স্তরের সম্মিলিত শক্তিই হাদি হত্যাচেষ্টার রাজনৈতিক পটভূমি।হাদিকে গুলি মানে-জুলাইকে গুলি,আশাকে গুলি,আদর্শকে গুলি,ভবিষ্যতকে গুলি।আজ আমাদের স্পষ্ট বলতে হবে-“জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে এই রাষ্ট্রের বৈধতা নেই।”হাদির ওপর হামলার বিচার হবেই-এটাই নতুন জুলাই শপথ।এটাই সত্যিকারের জুলাই প্রতিশোধ।
মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক,নবজাগরণ
www.thenabajagaran.com




