মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশ এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে,যার পরিণতি হবে-নতুন বাংলাদেশ বা নতুন দাসত্ব।যে রাষ্ট্রটি জুলাই বিপ্লবের উত্তাপে অগ্নিগর্ভ হয়ে ফেটে পড়েছিল, যে জনগণ বুকের রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারী শোষণের চক্র ভেঙে ফেলে এই দেশের মুক্ত বাতাস ফিরিয়ে এনেছিল-তাদের সামনে এখন সবচেয়ে জটিল,সবচেয়ে জীবন্ত ও সবচেয়ে অস্তিত্বগত প্রশ্নটি দাঁড়িয়ে আছে-
“যদি কাল বাংলাদেশে আক্রমণ হয়-আমরা কি প্রস্তুত?”
এই প্রশ্নটি অবাস্তব নয়।এটি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নয়।এটি রোমাঞ্চ নয়।এটি কল্পনা নয়।এটি বাস্তব, কারণ আমাদের চারদিকে যে ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ চলছে, সেখানে বাংলাদেশ একটি “সফট-টার্গেট”-যে রাষ্ট্রটি সামরিকভাবে দুর্বল, রাজনৈতিকভাবে পুনর্গঠিত, অর্থনৈতিকভাবে রূপান্তর-পর্বে এবং প্রশাসনিকভাবে অভ্যন্তরীণ শুদ্ধিকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।ঠিক এই সময়টাতেই ইতিহাস বলে-বাহ্যিক শক্তিগুলো আক্রমণ করতে সবচেয়ে পছন্দ করে।
সুইজারল্যান্ড-যে দেশ হিটলারকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল
ছোট দেশ, বড় শক্তি নয়। তবুও হিটলারের মতো আগ্রাসী নেতা সুইজারল্যান্ডকে আক্রমণ করেনি। কেন?কারণ-সুইজারল্যান্ড আগেই ঘোষণা করেছিল:“আমরা নিরপেক্ষ, কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে দুর্গ, ঘরে ঘরে সৈনিক।”তাদের প্রতিটি সেতু, প্রতিটি টানেল,প্রতিটি রাস্তা-বিস্ফোরক দিয়ে ভর্তি ছিল।প্রতিটি নাগরিক অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষিত।প্রতিটি পাহাড় পরিণত ছিল আড়াই লক্ষ ছোট ছোট দুর্গে। হিটলারের জেনারেলরা বিশ্লেষণ করে বলেছিল-“সুইজারল্যান্ড দখল করতে পারব। কিন্তু ধরে রাখতে পারব না।”
এটাই ছিল আসল ভয়।
বাংলাদেশ কি একই বার্তা দিতে প্রস্তুত?
না।আমরা প্রস্তুত নই।কারণ-আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ নেই।আমাদের গ্রামগুলো যুদ্ধকৌশলে সংগঠিত নয়।আমাদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা পুরনো ও আমলাতান্ত্রিক।আমাদের সীমান্ত দীর্ঘ, ছিদ্রযুক্ত এবং অসংরক্ষিত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-জুলাই বিপ্লবের পর প্রশাসনিক ও সামরিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন চলছে, যা এখনো পুরোপুরি দৃঢ় হয়নি।ঠিক এই সময়ে, ঠিক এই মুহূর্তে-রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হলে একটি নতুন নিরাপত্তা বাহিনী গঠন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এটি সেনাবাহিনীকে প্রতিস্থাপন নয়,বরং সেনাবাহিনীর পরিপূরক একটি বিশেষ বাহিনী-যা হবে সর্বজনীন প্রতিরক্ষার ভিত্তি।
কেন একটি নতুন নিরাপত্তা বাহিনী এখনই দরকার-৫টি জোরালো কারণ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা: বাংলাদেশ এখন Soft Target ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক,উভয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আঞ্চলিক শক্তির বদল,নতুন অর্থনৈতিক করিডোর-সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু। যে রাষ্ট্র দুর্বল-সেখানে আগ্রাসনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব ইতিহাস বলছে-দুর্বল রাষ্ট্রকে কখনো ক্ষমা করা হয় না।
জুলাই বিপ্লব একটি শূন্যতা তৈরি করেছে-যা পূরণ করা জরুরি জুলাই বিপ্লব রাষ্ট্রকে নতুন গতিতে এগিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু এই পরিবর্তনের পুরো সময়টাই হলো “ভালনারেবল টাইম-উইন্ডো”-যখন রাষ্ট্র সবচেয়ে অসুরক্ষিত থাকে। সেনাবাহিনী পুনর্গঠিত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনী রিফর্ম হচ্ছে।বিজিবি-র্যাবের কাঠামোও বদলাচ্ছে।এই শূন্যতা পূরণ করতে হবে-একটি নতুন নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে,যাদের নির্বাচিত, প্রশিক্ষিত ও সম্পূর্ণভাবে আধুনিক যুদ্ধ সক্ষম।এখানে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের জনগণ প্রস্তুত-কিন্তু সংগঠিত নয় বাংলাদেশ এমন এক জাতি-যারা যুদ্ধ হলে ভয় পায় না।
১৯৭১, ২০০১, ২০১৩, ২০১৮, ২০২৪, ২০২৫-
প্রতিটি আন্দোলনে প্রমাণ হয়েছে-বাংলার মানুষ লড়াই করতে জানে।কিন্তু আজ সবচেয়ে বড় সমস্যা:তারা সংগঠিত নয় তারা সামরিক প্রশিক্ষণহীন তারা গেরিলা কৌশল জানে না তারা দ্রুত প্রতিরোধ গড়তে পারে না তাদের হাতে অস্ত্র নেই তাদের কাছে লুকানো অস্ত্রাগার নেই সুইজারল্যান্ড জানত-প্রতিটি নাগরিকই হচ্ছে রাষ্ট্রের পরিণত রক্ষক।বাংলাদেশ এখনো সেই লেভেলে নেই।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ঝুঁকি:“মাথা কাটা রাষ্ট্র”সহ্য করতে পারবে না বর্তমান ইন্টারিম সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ধরে রাখা।কারণ-শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন প্রশাসনিক শুদ্ধিকরণ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দুর্নীতি দমন কমিশনের শক্তিশালীকরণ পুলিশ কমিশন আইন নারকোটিক্স ও ভূমি মাফিয়া দমন আমলা-রাজনীতিবিদ সিন্ডিকেট ভাঙা এসব পরিবর্তন দেশের ভেতরে বহু শক্তিকে কোণঠাসা করেছে।এরা যে কোনো মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করতে পারে। একটি নতুন নিরাপত্তা বাহিনী হবে-রাষ্ট্রের ভেতরের অদৃশ্য শত্রুদের বিরুদ্ধে ঢাল।
ভবিষ্যৎ: নতুন বাংলাদেশ প্রযুক্তিনির্ভর হবে-যার জন্য নতুন ধরনের বাহিনী চান সেনাবাহিনী যুদ্ধে যায়।কিন্তু ভবিষ্যৎ যুদ্ধ হবে-ড্রোন যুদ্ধ সাইবার যুদ্ধ স্টেলথ যুদ্ধ এআই-নিয়ন্ত্রিত ডিফেন্স বিশেষ অপারেশন গেরিলা মনস্তত্ত্ব ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি হাইব্রিড ও প্রোপাগান্ডা ওয়ার পুরনো কাঠামোয় এটি সম্ভব নয়।প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই নীতিতে বিশ্বাসী-নতুন সমস্যার জন্য নতুন সমাধান।সুতরাং-একটি নতুন,আধুনিক,প্রযুক্তিনির্ভর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী অপরিহার্য।
প্রস্তাবিত বাহিনী:জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী (NDF)-নতুন বাংলাদেশের ঢাল এটি হবে ১০,০০,০০০ সদস্যের একটি বাহিনী,নির্বাচন-প্রশিক্ষণ-তদারকি সবই হবে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দ্রুত মোতায়েন যুদ্ধ সক্ষমতা সীমান্ত প্রতিরক্ষা হামলার প্রথম প্রতিরোধ গেরিলা যুদ্ধ ড্রোন ও প্রযুক্তি যুদ্ধ জাতীয় সংকটে সর্বজনীন মোবিলাইজেশন।
এরা কারা হবে?
এসএসসি-এইচএসসি-দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষিত যুবক-যুবতী
স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে নির্বাচিত মেধাবী সুশৃঙ্খল, নৈতিক, দেশপ্রেমিক তরুণরা কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নয় কোনো কোটা নয় সম্পূর্ণ মেধাভিত্তিক বাছাই এটাই নতুন বাংলাদেশের পথ। প্রশিক্ষণে যা থাকবে অস্ত্র পরিচালনা ড্রোন তৈরি ও ড্রোন যুদ্ধ সাইবার সিকিউরিটি ছোট ইউনিট গেরিলা ট্যাকটিক্স আরবান ও জঙ্গল অপারেশন নদী-খাল-বিল অপারেশন বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইন্টেলিজেন্স সংগ্র মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ জরুরি দুর্যোগ প্রতিরোধ এরা হবে-২৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক সিভিল-ডিফেন্স বাহিনী।
বাংলাদেশের জন্য সুইজারল্যান্ডের শিক্ষা
আক্রমণকারীর মনে ভয় ঢুকাতে হবে আমাদের প্রতিটি গ্রাম দুর্গে পরিণত হতে হবে আক্রমণ করলে তাদের ক্ষতির পরিমাণ হবে ভয়াবহ-এটি জানাতে হবে গেরিলা যুদ্ধের জালে আটকে ফেলতে হবে রাষ্ট্রকে নাগরিক-সৈনিক ভিত্তিতে দাঁড় করাতে হবে জানি-কেউ কেউ বলবে:“এতো বড় বাহিনী দরকার কেন?”উত্তর একটাই-কারণ আমরা এমন এক ভূ-রাজনৈতিক সময়ে আছি, যখন দুর্বল রাষ্ট্রকে কেউ বাঁচিয়ে রাখে না।ভারতের মনস্তত্ত্বে ভয় ঢোকানো-এটাই কৌশল আপনি আক্রমণ ঠেকান অস্ত্র দিয়ে নয়-কিন্তু মনস্তত্ত্ব দিয়ে।
ভারতের মাথায় যদি এই বার্তাটি ঢুকে যায়-বাংলাদেশে ঢুকলে আর বের হওয়া যাবে না। বরং আসাম-ত্রিপুরা-নাগাল্যান্ড পর্যন্ত হারানোর ঝুঁকি আছে। তাহলে কোনো শক্তিই এদেশে আগ্রাসন করার সাহস পাবে না। এতটাই শক্তিশালী একটি জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি দেশের মনস্তাত্ত্বিক ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাষ্ট্র রক্ষার সময় এখন জুলাই বিপ্লব দেখিয়েছে-বাংলাদেশ নতুন করে জন্ম নিচ্ছে।বিচার বিভাগ পৃথক হলো-দুর্নীতি দমন আইন হলো-পুলিশ কমিশন হলো-রাষ্ট্র শুদ্ধ হচ্ছে-প্রশাসন বদলাচ্ছে-এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ-রাষ্ট্রকে রক্ষা করার বাহিনী তৈরি করা।
এটি না করলে-সব অর্জনই ধ্বংস হয়ে যাবে।
সব পরিবর্তনই ভেঙে পড়বে।সব স্বপ্নই শেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু আমরা যদি এখনই একটি নতুন জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করতে পারি-তাহলে নতুন বাংলাদেশ শুধু টিকে থাকবে না,বরং এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে উঠে দাঁড়াবে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নেয়ার সময় এসেছে-একটি নতুন নিরাপত্তা বাহিনী গঠন অনিবার্য-নতুন বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে এখনই।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক,নবজাগরণ





