মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
ভোলা সরকারি স্কুল মাঠ আজ দুপুরে রূপ নিয়েছিলো মানুষের জোয়ারে। হাজার হাজার মুসল্লি, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ, সাধারণ জনতা-সবাই একত্রিত হয়েছিলেন এক বরেণ্য আলেম, মাওলানা আমিনুল হক নোমানীর জানাজায়। মানুষের কান্না, শোক, ক্ষোভে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। অথচ এই ক্ষোভ কেবল এক ব্যক্তির মৃত্যুতে সীমাবদ্ধ নয়-এটি রাষ্ট্র ও সমাজের গভীরে নেমে আসা এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
প্রশ্ন জাগে-একজন সজ্জন আলেমকে কেন, কোন উদ্দেশ্যে হত্যা করা হলো? মানুষ বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, আমিনুল হক নোমানীর মতো শান্ত স্বভাবের, জ্ঞানী ও নির্লোভ একজন মানুষকে হত্যা করা সম্ভব। কিন্তু ইতিহাস বলছে, যখনই বাংলাদেশে নবজাগরণ, বিপ্লব, পরিবর্তনের হাওয়া ওঠে-তখনই শুরু হয় আলেম, ছাত্র, সাংবাদিক, মেধাবী তরুণ, বুদ্ধিজীবীদের ওপর আঘাত।
হঠাৎ আলেম হত্যার ধারাবাহিকতা
নুরাল পাগলাকে কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া, হাটহাজারীতে নিরীহ ছাত্রদের ওপর রক্তাক্ত হামলা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্মম নির্যাতন-এসব কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না, এগুলোই সেই দীর্ঘদিনের ব্লুপ্রিন্ট যার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে অস্থির করে রাখা, জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা।
আলেমরা বরাবরই এই দেশে জনগণের কাছে আস্থার প্রতীক ছিলেন। সাধারণ মানুষ আলেমদেরকে দেখে সত্য, ন্যায় ও নৈতিকতার দিশা পেত। তাই বারবার ষড়যন্ত্রকারীরা এই আলেমদের টার্গেট করেছে। উদ্দেশ্য একটাই-জনগণকে নেতৃত্বশূন্য করে ফেলা, যাতে প্রতিরোধ আন্দোলন ভেঙে যায়।
ঢাকসু থেকে জুলাই বিপ্লব: ষড়যন্ত্রের লাইন
মনে পড়ে, ঢাকসু নির্বাচনের সময় কীভাবে ভিপি প্রার্থীকে “পাকিস্তানি এজেন্ট” বলে ট্যাগ দেওয়া হয়েছিল? শুরুটা হয়েছিলো ভিপি নুরুল হক নুরকে দিয়ে। একজন তরুণ ছাত্রনেতা, যিনি গণমানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন, তাকে পাকিস্তানি আখ্যা দিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য স্পষ্ট-গণআন্দোলনের বৈধ নেতৃত্বকে কলঙ্কিত করা।
ঠিক একইভাবে, আজ আলেম হত্যার মাধ্যমে আবারও সেই একই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণ যে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল, সেটিকে ডাকাতি করার জন্য আবারও একই ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের যে আশা তৈরি হয়েছিল, তাকে ভিন্ন খাতে সরিয়ে নেওয়ার জন্য দেশি-বিদেশি চক্র নেমে পড়েছে মাঠে।
জুলাই বিপ্লব ডাকাতির নীলনকশা
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহাযুগান্তকারী ঘটনা। জনগণ রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে সেই স্বৈরাচারী শাসনের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলেছিল। কিন্তু আজ আমরা দেখি-সেই বিপ্লবের অর্জনগুলোকে দখল করার, বিকৃত করার চেষ্টা চলছে।
এই নীলনকশার অংশ হিসেবেই দেখা যাচ্ছে-
আলেম হত্যার মাধ্যমে জনগণের আস্থার জায়গাকে আঘাত করা,
ছাত্রনেতাদেরকে পাকিস্তানি-ভারতীয় ট্যাগ দিয়ে জনগণের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করা,
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকসু নির্বাচনের মতো প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তকে রক্তাক্ত করা,
এবং শেষ পর্যন্ত জনগণের বিজয়কে অচল করে দেওয়ার চেষ্টা করা।
ভোলার কর্মসূচি: প্রতিবাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
ভোলার জানাজার ময়দান থেকে যে তিন দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তা নিছক আনুষ্ঠানিক শোক নয়-বরং এটি হতে পারে নতুন প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা।
১. ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা শুধু শোক প্রকাশ নয়, বরং একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা।
২. বিক্ষোভ সমাবেশ ও শোক র্যালি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার এক কৌশল।
৩. ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রশাসনের কার্যকরী পদক্ষেপের আল্টিমেটাম দেখিয়ে দিয়েছে যে, জনগণ আর চুপ করে থাকবে না।
কে লাভবান?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো-এমন হত্যাকাণ্ড, দমন-পীড়ন, ষড়যন্ত্রে কারা লাভবান হচ্ছে? উত্তরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে-যারা জনগণের ঐক্যকে ভয় পায়, যারা জুলাই বিপ্লবের অগ্নিশিখা আবার জ্বলে উঠুক তা চায় না, তারাই এই নীলনকশার নেপথ্যে।
দেশকে আবারও অস্থিতিশীল করে তুলতে, ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও দেশীয় দোসররা জোট বেঁধেছে। ইতিহাস সাক্ষী-যখনই বাংলাদেশে মুক্তির আন্দোলন গতি পেয়েছে, তখনই বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ বেড়েছে।
প্রতিরোধের ডাক
মাওলানা আমিনুল হক নোমানীর হত্যার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; এটি রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক গভীর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ। আমরা যদি এই ষড়যন্ত্র চিনতে ব্যর্থ হই, তবে জুলাই বিপ্লবের অর্জনগুলো একে একে ডাকাতির শিকার হবে।
আজ তাই সময় এসেছে-আলেম হত্যার বিচার দাবি করার,
ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করার,জুলাই বিপ্লবের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নতুন করে ঐক্য গড়ে তোলার।
মাওলানা নোমানীর জানাজার মাঠে যে ঢল নেমেছিল,সেটি শুধু শোকের নয়-এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ হয়ে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
www.thenabajagaran.com শেয়ার করুন সবাই