বদরুদ্দীন উমর:সময়ের সাহসী সন্তান,ইতিহাসের অমর যোদ্ধা

নবজাগরণ ডেস্ক:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যারা শুধু তাদের সময়ে নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও আলো ফেলে যায়। বদরুদ্দীন উমর ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন। তিনি ছিলেন বামপন্থী চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও সাহসী সত্যভাষী। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি রচনা, প্রতিটি বিশ্লেষণ ছিল শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যা ও ভ্রান্ত প্রচারণার বিরুদ্ধে এক অনন্য প্রতিবাদ।

২০২৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রোববার সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে ৯৪ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর প্রস্থান একটি বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তার ভাণ্ডার আমাদের জাতীয় সংগ্রামের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন বদরুদ্দীন উমর। পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক চেতনায় গড়া। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যে, ইতিহাসে ও সমাজবিজ্ঞানে তাঁর কৌতূহল প্রবল ছিল।

১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এখানেই তাঁর দার্শনিক চিন্তার ভিত শক্ত হয়। পরে তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পিপিই (Philosophy, Politics and Economics) ডিগ্রি অর্জন করেন। এই শিক্ষাজীবন তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুক্তিবাদী, বিশ্লেষণাত্মক ও সমালোচনামূলক চিন্তার ভেতর দিয়ে গড়ে তোলে।
অক্সফোর্ড থেকে ফিরে এসে তিনি শুধু শিক্ষক বা গবেষক নন, বরং হয়ে উঠলেন এক তাত্ত্বিক যোদ্ধা।

বামপন্থী দর্শন ও রাজনৈতিক অবস্থান
উমর ছিলেন দৃঢ় মার্কসবাদী। তাঁর কাছে সমাজতন্ত্র মানে শুধু অর্থনৈতিক সমতা নয়, বরং সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ইতিহাসের সর্বাঙ্গীন মুক্তি। তিনি দেখিয়েছেন-বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে যদি সমাজতন্ত্রের সাথে যুক্ত করা না হয়, তবে সেটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

তাঁর বহু রচনা, যেমন-“বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের সমস্যা”,
“সংস্কৃতি ও রাজনীতি”,“জাতীয় প্রশ্ন ও জাতীয়তাবাদ”,
এগুলোতে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি বাম রাজনীতিকে কেবল দলীয় সীমারেখায় দেখেননি, বরং সমাজ পরিবর্তনের সর্বাত্মক দর্শন হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন।
লেখক ও গবেষক হিসেবে অবদান
বদরুদ্দীন উমরের রচনাসম্ভার অসংখ্য। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-

১. বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (তিন খণ্ড)- ভাষা আন্দোলনের শিকড়, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে তিনি নতুনভাবে উন্মোচন করেছেন।
২. সংস্কৃতি ও রাজনীতি-দেখিয়েছেন, সংস্কৃতি কখনো নিরপেক্ষ নয়; এটি সবসময় শ্রেণি ও রাজনীতির সাথে যুক্ত।
৩. মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি-সরকারি প্রচারণার বাইরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের সংকট এবং সাধারণ মানুষের ভূমিকা তিনি তুলে ধরেন।
৪. জাতীয় প্রশ্ন ও জাতীয়তাবাদ-বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

এইসব গ্রন্থ তাঁকে শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক বামপন্থী গবেষণার ক্ষেত্রেও একটি সম্মানজনক আসনে বসিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর অবস্থান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে তিনি সবসময় সরকারের প্রচলিত বয়ানের বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মতে-শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নয়।
আওয়ামী লীগের কোনো সামরিক প্রস্তুতি ছিল না, জনগণ ও বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তারাই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন।

৭ মার্চের ভাষণ ছিল আপসকামী ও দ্বন্দ্বপূর্ণ; সেটি স্বাধীনতার ঘোষণা নয়। শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, গ্রেফতার হননি।এই ব্যাখ্যা অনেকের কাছে অস্বস্তিকর হলেও গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়ে উমর তার পক্ষে দৃঢ় যুক্তি হাজির করেছেন। তিনি বলেন-

“মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নায়ক সাধারণ জনগণ, যারা লাঠি-সোটার চেয়ে বেশি শক্তি, আত্মত্যাগ আর সামরিক সাহস নিয়ে লড়াই করেছে।”
স্বাধীনতার পরের রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ
বদর উদ্দিন উমরের মতে, স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু জনগণের আশা পূরণ না করে তিনি লুটপাট, রক্ষীবাহিনী ও একদলীয় বাকশাল চালু করেন।

তিনি বলেছিলেন-
রক্ষীবাহিনী গঠন করে জনগণকে দমন করা হয়েছিল।
সংবাদপত্র বন্ধ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।দুর্ভিক্ষ ও দমননীতির ফলে আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারায়।উমর দেখিয়েছেন, আওয়ামী লীগের এই শাসনব্যবস্থা ছিল স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

গণঅভ্যুত্থান ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশের ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় তিনি দেখিয়েছেন-
১৯৫২: ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক মুক্তির দ্বার খুলে দেয়।
১৯৬৯: আইয়ুব খানের পতন ঘটায়।
১৯৯০: এরশাদের পতন ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
২০২৪: শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বিস্ফোরক ও রূপান্তরমূলক অভ্যুত্থান।

তাঁর ভাষায়,
“৫ আগস্ট, ২০২৪ বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় মুক্তির দিন। জনগণ যে স্বাধীনতা আজ উপভোগ করছে, ১৯৭২ সালের পর তা আর দেখা যায়নি।”

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
উমর শুধু বাংলাদেশের সীমায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি দেখিয়েছেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এতো সর্বগ্রাসী গণঅভ্যুত্থান কখনো দেখা যায়নি। তাঁর বিশ্লেষণ আন্তর্জাতিক বাম রাজনীতি ও মুক্তির সংগ্রামের সাথেও গভীরভাবে সম্পর্কিত।

সমালোচনা ও বিতর্ক
অবশ্যই তাঁর সাহসী অবস্থানের জন্য অনেকেই তাঁকে সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী মহল তাঁকে “বিতর্কিত” বলে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো সত্য উচ্চারণ থেকে পিছিয়ে আসেননি। তাঁর কলমের শক্তি ছিল শাসকের দমননীতির বিরুদ্ধে এক অনমনীয় প্রতিরোধ।

ব্যক্তিত্ব ও উত্তরাধিকার
বদরুদ্দীন উমর ছিলেন নির্লোভ, সাদামাটা জীবনযাপনকারী। জীবনের শেষ বয়সেও তিনি গবেষণা, লেখা ও সাক্ষাৎকারে সক্রিয় ছিলেন।

তাঁর উত্তরাধিকার আমাদের শেখায়-
১. সত্য বলার সাহস ইতিহাসে অমর করে রাখে।
২. জনগণই ইতিহাসের চালিকাশক্তি-কোনো নেতা বা দল নয়।
৩. সংস্কৃতি ও রাজনীতি অবিচ্ছেদ্য-সংস্কৃতি দিয়ে রাজনীতি ঢেকে রাখা যায় না।

নবজাগরণের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ বাংলাদেশ যখন নতুন রাষ্ট্রগঠন, নতুন সংবিধান ও জনগণের স্বাধীনতা পুনর্নির্মাণের পথে হাঁটছে, তখন বদরুদ্দীন উমরের প্রস্থান আমাদের জন্য এক বিশাল শূন্যতা। কিন্তু তাঁর চিন্তা, গবেষণা ও সংগ্রাম আমাদের পথ দেখাবে।নবজাগরণ পরিবার বদরুদ্দীন উমরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে।তিনি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন সত্য ও সংগ্রামের দীপশিখা।

বদরুদ্দীন উমর ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই সাহসী কণ্ঠস্বর, যিনি শাসকের ভ্রান্তি ও মিথ্যার মুখে অকপটে সত্য উচ্চারণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন-
“জনগণের শক্তিকে কখনো দমন করা যায় না, ইতিহাসের চাকা সর্বদা মুক্তির দিকে ঘোরে।”
আজ তাঁর মৃত্যু আমাদের দুঃখিত করেছে, কিন্তু তাঁর চিন্তা আমাদের উজ্জীবিত করবে। তিনি সময়ের সন্তান, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন চিরকাল।

লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-
নবজাগরণ
আরো জানতে পড়ুন শেয়ার করুন :
www.thenabajagaran.com