নবজাগরণ রিপোর্ট :
বাংলাদেশের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। দীর্ঘ তিন দশকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার যে আত্মত্যাগ, রক্ত ও ত্যাগস্বীকারের ধারা এই বিপ্লবে প্রবাহিত হয়েছিল, তা আজও জাতির হৃদয়ে স্পন্দিত হয়। সেই বিপ্লব শুধু ক্ষমতার পালাবদল ঘটায়নি, বরং এটি ছিল একটি প্রজন্মের আত্মপ্রত্যয়ের গর্জন, একটি জাতির মুক্তির নতুন স্বপ্নের সূচনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য-এই বিপ্লবের রক্তাক্ত সৈনিকরা, যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, তারাই আজ রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার। এক বছর পেরিয়ে গেলেও আহত সৈনিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি, ভুক্তি ঝুলে রাখা হয়েছে। এ যেন ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর এক ভয়ঙ্কর নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।
জুলাই বিপ্লব:আত্মত্যাগের মহাকাব্য
জুলাই বিপ্লব কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। তিন দশকের একচেটিয়া দমননীতি, দুর্নীতি, গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে অসন্তোষ জমতে জমতে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তা বিস্ফোরিত হয়েছিল। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, সাংবাদিক, বেকার যুবক-সবাই মিলে গড়ে তুলেছিল এক অদম্য প্রতিরোধ।
ঢাকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মতো। পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয়েছিল অসংখ্য তরুণ, শত শত আহত হয়েছিলেন লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় তৈরি হয়েছিল শহীদ ও আহত সৈনিকের তালিকা। এদের আত্মত্যাগের কারণেই আজ বাংলাদেশ নতুন গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে।
কিন্তু সেই যোদ্ধাদের নাম ও পরিচয় এখনো রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নথিতে নেই-এ এক লজ্জাজনক সত্য।
আহত সৈনিকদের তালিকা ঝুলে থাকা: লজ্জাজনক বিলম্ব এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের সময় আহতদের তালিকা তৈরি করার জন্য কমিটি গঠন, মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ, মেডিকেল রেকর্ড সংরক্ষণ-এসব কথা শোনা গেলেও বাস্তবে আজও তালিকা প্রকাশ হয়নি।
এমন অবহেলার পরিণতি ভয়াবহ।
আহতরা চিকিৎসা বঞ্চিত: অধিকাংশ আহত যুবক ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পেরে আজও পঙ্গুত্বের শিকার।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত: কর্মক্ষমতা হারানো অনেকেই জীবিকা নির্বাহে অক্ষম, পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবে আছে।
মানসিক যন্ত্রণা: রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না পাওয়ায় তারা নিজেকে অবহেলিত, অপমানিত ও বঞ্চিত মনে করছেন।
প্রশ্ন জাগে-রাষ্ট্র কি ইচ্ছে করেই এই তালিকা ঝুলিয়ে রেখেছে? নাকি এটি কেবল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা?
অবহেলার গভীর সংকট: রাষ্ট্র কি বিপ্লবকে অস্বীকার করছে?
একটি জাতির ইতিহাস তার রক্তাক্ত সংগ্রামের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। অথচ আজ যারা সেই ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী, যারা নিজের রক্ত ঢেলে রাষ্ট্রকে নতুন পথে নিয়ে এসেছে, তাদের অবহেলিত করা হচ্ছে। এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং বিপ্লবকে অস্বীকার করার একটি সাংকেতিক বার্তা।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশূন্যতা
আহত সৈনিকদের স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা ছিল রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।বিপ্লবের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।রাজনৈতিক টালবাহানা-কোনো রাজনৈতিক দল যেন বেশি কৃতিত্ব না পায়-এই আশঙ্কায় তালিকা প্রকাশে গড়িমসি চলছে।প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরা আহতদের দুর্দশাকে উপেক্ষা করে নিজেদের ক্ষমতাসীন অবস্থানকে নিরাপদ রাখতেই বেশি ব্যস্ত।
বিপজ্জনক বার্তা
এই অবহেলা বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে-যেন রাষ্ট্র বলতে চাইছে: “আন্দোলনে অংশ নাও, রক্ত দাও, কিন্তু রাষ্ট্র তোমাকে স্বীকৃতি দেবে না।” এটি ভবিষ্যতের গণআন্দোলনের প্রতি সরাসরি হুমকি।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা: এখনই যা জরুরি
এই অবহেলা আর চলতে দেওয়া যায় না। অবিলম্বে আহত সৈনিকদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক) তালিকা প্রকাশ ও যাচাই
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দ্রুত যাচাই সাপেক্ষে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে হবে।
তালিকা প্রকাশ্যে আনতে হবে যাতে জনগণ তা পর্যালোচনা করতে পারে।
খ) চিকিৎসা ও পুনর্বাসন
প্রতিটি আহত সৈনিকের চিকিৎসা ব্যয় রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে।
যারা স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের জন্য বিশেষ ভাতা ও পুনর্বাসন প্রকল্প চালু করতে হবে।
গ) ক্ষতিপূরণ ও সম্মান
আহত ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
জাতীয় দিবসে তাদের সম্মাননা দিতে হবে, ইতিহাসে তাদের স্থান সংরক্ষণ করতে হবে।
ঘ) আইনগত সুরক্ষা
আহত সৈনিকদের অধিকার রক্ষার জন্য একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে হবে।
এই অবহেলার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
বিপ্লবকে অপমান মানে জনগণকে অস্বীকার
জুলাই বিপ্লব ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক জাগরণ। সেই জাগরণের রক্তাক্ত সৈনিকদের অবহেলা করে রাষ্ট্র কেবল তাদের নয়, বরং পুরো জাতিকেই অপমান করছে।যারা নিজেদের জীবন ও ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় ঘটিয়েছেন, তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা অনিবার্য।
অতএব,এখনই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আহত সৈনিকদের তালিকা প্রকাশ, চিকিৎসা-ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা ইতিহাসের কাছে আমরা পরাজিত হব, আর জুলাই বিপ্লবের মহিমা কলঙ্কিত হবে।বিপ্লবকে অবজ্ঞা করা মানে জনগণের অভিপ্রায়কে অস্বীকার করা।আহত সৈনিকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনই হবে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গীকার।
লেখক:মো: আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক
নবজাগরণ
জুলাই যোদ্ধা-আহত সাংবাদিক
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com