মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
একটি নির্বাচনের বাইরেও বাংলাদেশে আঞ্চলিক সমিতিগুলোর ভিড়ে “নোয়াখালী জেলা সমিতি-ঢাকা”একটি আলাদা নাম। এটি কেবল নোয়াখালীর মানুষের সামাজিক বন্ধন নয়,বরং রাজধানীতে অবস্থানরত প্রায় ৩০–৩৫ লাখ নোয়াখালীবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির প্রতীক।
তাই যখন এই সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচন আসে, তখন সেটি হয়ে ওঠে শুধু একটি অভ্যন্তরীণ লড়াই নয়, বরং ঐতিহাসিক এক সামাজিক ঘটনার রূপ। ২০২৫–২০২৭ মেয়াদের নির্বাচন সেই ধারাবাহিকতারই নতুন অধ্যায়।
নির্বাচনকে ঘিরে রাজধানীতে এখন তৈরি হয়েছে উত্তেজনা, উৎসাহ আর বিতর্কের এক অনন্য আবহ। আর সেই আবহকে আরও তীব্র করেছে অনুষ্ঠিত নয়াপল্টনের হোটেল ভিক্টরির মতবিনিময় সভা।
মতবিনিময় সভা: ঐক্যের মঞ্ সভা পরিচালনা করেন জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া, সভাপতিত্ব করেন অভিজ্ঞ সংগঠক এবি.এম. ফারুক। এই দুইজনের দক্ষ হাতে পুরো অনুষ্ঠান শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এগোয়। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আব্দুল মাবুদ দুলাল। এছাড়া ব্যবসায়ী অঙ্গনের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর
হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- টাইমস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবুল খায়ের, টপস্টার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হারুন এমজেএফ,এবং নোয়াখালী জেলা বিএনপি নেতা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মিয়া মোহাম্মদ ইলিয়াছ।এছাড়া সেনবাগসহ নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হয়ে এই সভাকে জনসমুদ্রে পরিণত করেন।
অতিথিদের বক্তব্য ও বার্তা
জয়নুল আবেদিন ফারুক:ঐক্যের ডাক সাবেক বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক তার বক্তব্যে বলেন-নোয়াখালীবাসী ঐক্যবদ্ধ হলে জাতীয় রাজনীতির বড় পরিবর্তন সম্ভব। আঞ্চলিক সমিতি কোনো ব্যক্তির পদকেন্দ্রিক লড়াইয়ের জায়গা নয়; এটি সামাজিক উন্নয়ন ও মর্যাদার প্ল্যাটফর্ম।
আগামী নির্বাচনকে তিনি অভিহিত করেন “ঐক্য ও বৈষম্যহীন নেতৃত্বের পরীক্ষার মঞ্চ” হিসেবে। আব্দুল মাবুদ দুলাল: প্রশাসনিক স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি ঢাকা রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আব্দুল মাবুদ দুলাল বলেন-প্রশাসনে যেমন স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা প্রয়োজন,তেমনি একটি সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্বেও তা অপরিহার্য।
নোয়াখালী জেলা সমিতি হতে পারে স্বচ্ছ, আধুনিক ও কার্যকর নেতৃত্বের মডেল। তার বার্তায় উপস্থিত জনতার মধ্যে এক ধরনের দৃঢ় আস্থা তৈরি হয়।ব্যবসায়িক নেতৃত্বের বার্তা
আবুল খায়ের, সৈয়দ হারুন এমজেএফ ও মিয়া মোহাম্মদ ইলিয়াছ স্পষ্ট বার্তা দেন-
অর্থনৈতিক শক্তি ও সামাজিক দায়িত্ব একসাথে চলতে হবে।
সমিতি হতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের উন্নয়নকেন্দ্র।
তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, নোয়াখালীর ব্যবসায়ীরা কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই চান না; চান একটি মর্যাদাবান সামাজিক ঐক্য।
নোয়াখালী জেলা সমিতির ঐতিহাসিক গুরুত্ব
১৯৬০-এর দশক থেকেই ঢাকায় বসবাসরত নোয়াখালীবাসী তাদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এই সমিতি গড়ে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সমিতি ছিল সংগঠন ও অর্থ সংগ্রহের কেন্দ্র।
স্বাধীনতার পর এটি প্রবাসীদের জন্য সামাজিক সহায়তার অন্যতম ভরসা।বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সহায়তা ও সামাজিক কার্যক্রমে সমিতির অবদান আজও স্মরণীয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অভিযোগ উঠেছে-
সমিতি কখনও কখনও দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির শিকার হয়েছে।
নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
ফলে নতুন প্রজন্ম চাইছে এক ভিন্ন নেতৃত্ব-যারা ঐতিহ্য রক্ষা করবে, আবার আধুনিক সমাজসেবা নিশ্চিত করবে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব
নোয়াখালীবাসী শুধু সংখ্যায় বড় নয়, অবদানেও অনন্য।
দেশের প্রবাসী রেমিট্যান্সে নোয়াখালীবাসীর অবদান প্রায় ২০%।
ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজধানীর অন্যতম নিয়ন্ত্রণশক্তি নোয়াখালীর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী।প্রশাসন, রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় অসংখ্য নোয়াখালীবাসী নেতৃত্ব দিচ্ছেন।তাই এই সমিতির নেতৃত্ব সরাসরি প্রভাব ফেলে-প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষা,শিক্ষায় বৃত্তি প্রদান,চিকিৎসা সহায়তা,এমনকি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও।
নির্বাচনকে ঘিরে প্রত্যাশা ও বিতর্ক
এইবারের নির্বাচন ঘিরে সবচেয়ে আলোচিত নাম “বেলাল-দুলাল পরিষদ”।সভাপতি প্রার্থী শিল্পপতি এম এ খান বেলাল (ব্যালট নং ১)সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ডিআইজি আব্দুল মাবুদ দুলাল (ব্যালট নং ২)
মোট ৩১ জন নিয়ে গঠিত এ প্যানেল ইতোমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।তাদের প্রতিশ্রুতি-বৈষম্যহীন নেতৃত্ব
ঐক্যবদ্ধ নোয়াখালীবাসীউন্নয়ন ও সমাজসেবা কেন্দ্রিক কার্যক্রম
তবে বিরোধীরা বলছেন-এটি এক ধরনের প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক আঁতাত।জনগণ এখন প্রশ্ন করছে-
নেতৃত্ব কি জনগণের জন্য,নাকি ক্ষমতার জন্য?
বিপ্লবী প্রশ্ন সামনে
এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে-
ঐতিহাসিক ভাঙন কি এবার কাটবে?দীর্ঘদিন ধরে সমিতি বিভাজনের শিকার। বেলাল-দুলাল প্যানেল সেই ভাঙন নিরসনের অঙ্গীকার করেছে। অর্থনীতি ও প্রশাসনের সমন্বয় কি সফল হবে?ব্যবসায়ী ও পুলিশ কর্মকর্তা একসাথে কাজ করতে পারবেন তো?
জাতীয় রাজনীতির প্রভাব কতটা পড়বে?
জয়নুল আবেদিন ফারুকের উপস্থিতি প্রমাণ করে-এই নির্বাচনও জাতীয় রাজনীতির রঙে রাঙানো।জনতার অংশগ্রহণসভায় সেনবাগ, কোম্পানীগঞ্জ, চাটখিল,বেগমগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা বিপুল মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে-এটি কোনো অভিজাত ক্লাবের নির্বাচন নয়;এটি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন।
মানুষ চায়-ভাতৃসুলভ ঐক্যসেবামুখী নেতৃত্বভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মর্যাদা ও গৌরবনোয়াখালী জেলা সমিতি: আগামীর দিশাএই নির্বাচন শুধুমাত্র একটি কমিটি গঠনের বিষয় নয়; এটি হচ্ছে-বিভাজন বনাম ঐক্যের লড়াই ব্যক্তিস্বার্থ বনাম বৈষম্যহীন নেতৃত্ব
স্থবিরতা বনাম রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ
যদি বেলাল-দুলাল পরিষদ জয়ী হয়,তবে এটি হতে পারে একটি নতুন ইতিহাসের সূচনা।যদি ব্যর্থ হয়, তবে নোয়াখালীবাসী আবারও অতীতের বিভাজনের মধ্যে হারিয়ে যাবে। ঐক্যের বিপ্লবী ডাক
নয়াপল্টনের হোটেল ভিক্টরির মতবিনিময় সভা আমাদের শিখিয়েছে-
নোয়াখালীবাসীর ঐক্য ভাঙার নয়।
রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা একসাথে এলে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
এখন প্রয়োজন সাহসী, স্বচ্ছ ও বৈষম্যহীন নেতৃত্ব।
১৩ সেপ্টেম্বরের ভোট তাই হবে এক ঐতিহাসিক দিন।
সেদিন ঠিক হবে-নোয়াখালী জেলা সমিতি কি হবে কেবল একটি সামাজিক সংগঠন, নাকি হবে বৈষম্যহীন নেতৃত্বের বিপ্লবী পতাকা?
বার্তা স্পষ্ট:নোয়াখালীর ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। এবারও সেই ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে ঐক্য,বৈষম্যহীন নেতৃত্ব ও সাহসী সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ
জুলাই যোদ্ধা-আহত সাংবাদিক।





