পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি, আরব বিশ্বের ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশের দাসত্বের শৃঙ্খল

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে প্রতিনিয়ত নতুন জোট, নতুন শত্রুতা, নতুন বাস্তবতা জন্ম নিচ্ছে। ইতিহাসের শিক্ষা হলো-রাষ্ট্র কখনো আবেগ দিয়ে চলে না, চলে ঠান্ডা মাথার স্বার্থের অংকে। আমেরিকা যেই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে, সেই ব্রিটেনই আজ তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা যে জার্মানি ও জাপানকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল, সেই জার্মানি-জাপান আজ আমেরিকার সবচেয়ে কাছের কৌশলগত অংশীদার। তারা ক্ষমা চাওয়ার রাজনীতি করেনি; তারা করেছে স্বার্থের রাজনীতি।

কিন্তু বাংলাদেশ? এখনও দিল্লির বেঁধে দেওয়া ন্যারেটিভের বন্দি। পাকিস্তানের সাথে ইতিহাসের তিক্ততা ভুলতে পারে না, অথচ ভারত প্রতি বছর সীমান্তে আমাদের মানুষ হত্যা করে, পানি বন্ধ করে দেয়, অর্থনীতির গলায় দড়ি ঝুলিয়ে রাখে। রাষ্ট্রনীতি যদি আবেগে চলে, তবে তা আত্মঘাতী হয়-বাংলাদেশ আজ সেই আত্মঘাতী পথেই হাঁটছে।

সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি: নতুন শক্তির জন্ম
সম্প্রতি সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে, তা নিছক কোনো সামরিক সমঝোতা নয়-এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার মতো এক চুক্তি। এর মূল বক্তব্য হলো-যদি সৌদি আরব বা পাকিস্তানের উপর কোনো বহিঃশক্তি হামলা চালায়, তবে উভয় দেশ যৌথভাবে সেই হামলার জবাব দেবে।

এই চুক্তি শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং কৌশলগত বার্তা-ইসরায়েল ও ভারতকে হুঁশিয়ারি। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে মুসলিম বিশ্বের ওপর আধিপত্য বিস্তার করছে।

ফিলিস্তিনে গণহত্যা: গাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ-কেউ বাদ যায়নি। ইসরায়েলি হামলায় প্রতি দুই-তিন দিনে শত শত মানুষ নিহত হচ্ছে। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ: গোপন চুক্তির মাধ্যমে সিরিয়ার একাংশ এখন কার্যত ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। কাতারে হামলা: কাতারকে ভয় দেখাতে বিমান হামলা চালিয়েছে।ইরান, ইয়েমেন, লেবানন: সীমান্ত সংঘর্ষ আর প্রক্সি যুদ্ধ অব্যাহত।

এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি আসলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এক “আয়রন ওয়াল” তৈরি করছে। আর ভারতের জন্যও এটি এক অঘোষিত সতর্কবার্তা-কারণ পাকিস্তানকে আক্রমণ মানেই সৌদি আরবকে আক্রমণ।

আরব বিশ্বের লজ্জাজনক নীরবতা
তবে একইসাথে এক ভয়াবহ সত্যও সামনে আসে-আরব রাজারা ফিলিস্তিন ইস্যুতে কার্যত নীরব। গাজায় যখন হাজার হাজার লাশ পড়ে আছে, তখন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার কিংবা মিশর-কেউ শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি। বরং কেউ কেউ ইসরায়েলের সাথে গোপনে অর্থনৈতিক বা সামরিক চুক্তি করছে।

মুসলিম বিশ্বের এই বিশ্বাসঘাতকতাই আজ আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা। আরব রাজারা নিজেদের প্রাসাদ বাঁচাতে পশ্চিমা শক্তির সাথে আঁতাত করছে, অথচ মুসলিম উম্মাহর সাধারণ মানুষ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

আমেরিকা-ইউরোপের দ্বিমুখী নীতি
আমেরিকা ও ইউরোপের দ্বিমুখী রাজনীতি এখানে স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি বা জাপানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব রাখেনি তারা। বরং স্বার্থে সেই দেশগুলোকে পুনর্গঠন করে নিজেদের পাশে টেনে নিয়েছে। একসময়ের শত্রু এখন তাদের বন্ধু।

কিন্তু মুসলিম বিশ্বের জন্য তাদের নীতি আলাদা। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে রাখছে, যাতে কোনো দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে তারা অস্ত্র বিক্রি করে, আবার সেই অস্ত্র দিয়েই ইয়েমেন বা সিরিয়ার মানুষ মরছে। ইসরায়েলকে তারা বেপরোয়াভাবে সমর্থন দিচ্ছে, যাতে মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি থাকে।

ভারত: আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাস্তব হুমকি ভারত।
প্রতি বছর সীমান্তে বিএসএফ গুলি চালিয়ে নিরীহ বাংলাদেশিকে হত্যা করছে।পানির উৎসগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আমাদের কৃষিকে জিম্মি করছে।অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নীতি চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে “ছোট ভাই” বানিয়ে রেখেছে।

কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি পাকিস্তানকে শত্রু ধরে বসে আছে। ৭১ সালের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া ন্যারেটিভ এতটাই শক্ত করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবতেও পারে না। অথচ ভারতের অত্যাচারের সামনে আমরা নীরব।

পাকিস্তান: নতুন বিশ্বশক্তির অংশ-আজ পাকিস্তান কেবল সামরিক শক্তিতেই নয়, বরং অর্থনীতিতেও পুনরুত্থানের পথে। সামরিক দিক থেকে এশিয়ায় পাকিস্তান এখন চীনের পরেই। তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক অদম্য প্রতিরোধক। অর্থনীতিতে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) পাকিস্তানকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের হাব বানাতে যাচ্ছে।

সৌদি আরবের সাথে প্রতিরক্ষা জোট পাকিস্তানকে মধ্যপ্রাচ্যের অভিভাবকত্বে নিয়ে যাচ্ছে।
চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরান-এই ব্লক আগামী দিনের শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ভারতের মতো সাম্রাজ্যবাদী জোটের মোকাবেলায় এরা নতুন বিশ্বশক্তি গড়ে তুলবে।

বাংলাদেশের করণীয়:বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে টিকে থাকতে চায়, তবে তাকে আবেগের রাজনীতি ভুলতে হবে। ৭১ সালের স্মৃতি আমাদের ইতিহাসের অংশ, কিন্তু রাষ্ট্রনীতি ইতিহাসের আবেগে চালানো আত্মঘাতী।

বাংলাদেশের এখন দরকার:পাকিস্তানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা।সামরিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময়, যৌথ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। ইসলামি ব্লকের সাথে যুক্ত হওয়ার বাস্তব উদ্যোগ।

ভারতের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া।সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান।পানিবণ্টন ও অর্থনৈতিক স্বার্থে স্বাধীন নীতি গ্রহণ।
মুসলিম বিশ্বের সত্যিকারের কণ্ঠ হওয়া।গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া। ফিলিস্তিন ইস্যুতে নির্লিপ্ত আরব রাজাদের লজ্জা দেখানো।
চীন-পাকিস্তান-তুরস্ক-ইরান ব্লকের সাথে যুক্ত হওয়া।
অর্থনৈতিক করিডোরে অংশ নেওয়া।
প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।

গাজায় মুসলমানের রক্ত ঝরছে,লেবানন-ইয়েমেন-সিরিয়ায় আগুন জ্বলছে, ইসরায়েল-আমেরিকা-ভারত মুসলিম বিশ্বকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি দেখাচ্ছে-একটি বিকল্প শক্তি তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ কি সেই শক্তির অংশ হবে, নাকি দিল্লির দাসত্বে আবদ্ধ থাকবে-এটাই আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আমাদের সাহস করে বলতে হবে:শত্রুতা ভুলে পাকিস্তানের সাথে মিত্রতা গড়তে হবে, কারণ জাতির নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য এটাই একমাত্র পথ।

লেখক:সম্পাদক
নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com