মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস শুধু বিজয়ের গল্প নয়। এটি একই সঙ্গে একটি রাষ্ট্রীয় লুটপাটের ইতিহাস, একটি নীরব বিশ্বাসঘাতকতার দলিল এবং একটি অসম্পূর্ণ মুক্তির ট্র্যাজেডি। ১৯৭১ সালে আমরা সামরিকভাবে পাকিস্তানকে পরাজিত করলেও, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমরা যে এক নতুন শৃঙ্খলে বন্দী হতে যাচ্ছি-সে সতর্কবার্তা সেদিন খুব কম মানুষই উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন।আজ, অর্ধশতাব্দী পর, যখন কেউ ভারতের “অবদান” নিয়ে নীতিকথা শোনান, তখন ইতিহাসের দায় থেকে পালিয়ে যাওয়ার এই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে কাগজে-কলমে হিসাব তুলে ধরা জরুরি হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধ শেষের মহালুট:অস্ত্র,শস্য ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ
যুদ্ধশেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় দুইশ’ওয়াগন রেলগাড়ী ভর্তি করে ২৭০০ কোটি টাকার অস্ত্র-শস্ত্র লুটের অভিযোগ কোনো গুজব নয়;এটি লিখিত ইতিহাস।
সূত্র: দৈনিক অমৃতবাজার,১২ মে ১৯৭৪।আজকের বাজারে এর মূল্য প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার।এটি শুধু অস্ত্র নয়-এটি ছিল একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে সামরিকভাবে পঙ্গু করে রাখার প্রথম ধাপ।এরপর আসে শস্য লুট-ধান,চাল, গম মিলিয়ে ৭০-৮০ লাখ টন। গড়ে ১০০ টাকা ধরলেও দাঁড়ায় ২১৬০ কোটি টাকা, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।এমন এক সময়ে এই শস্য পাচার হয়েছে, যখন বাংলাদেশের মানুষ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিল।সূত্র:মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম।
পাট:সোনালি আঁশ থেকে সোনালি শোষণ
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল পাট। যুদ্ধের পর ৫০ লাখ বেলেরও বেশি পাট লুট করা হয়-মূল্য ৪০০ কোটি টাকা,আজকের হিসাবে ১.৫ বিলিয়ন ডলার।এই পাট শুধু কাঁচামাল হিসেবে যায়নি; বাংলাদেশের শিল্প সক্ষমতাকে ধ্বংস করে,আগরতলায় পাঁচটি নতুন পাটকল স্থাপনের যন্ত্রাংশ সরিয়ে নেওয়া হয়।সূত্র: আখতারুল আলম, দুঃশাসনের ১৩৩৮ রজনী।এটি কি সহযোগিতা,না কি পরিকল্পিত শিল্পহরণ?ত্রাণের নামে পাচার,সাহায্যের নামে ডাকাতি যুদ্ধোত্তর সময়ে যে ত্রাণ আসার কথা ছিল বিধ্বস্ত মানুষের জন্য, তার বড় অংশই পাচার হয়ে যায়।হিসাব বলছে-১৫০০ কোটি টাকা, আজকের বাজারে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার।
এর সঙ্গে যোগ করুন-যুদ্ধাস্ত্র,ওষুধ,মাছ,গরু,বনজ সম্পদ-আরও ১০০০ কোটি টাকা,আজকের হিসাবে ৬ বিলিয়ন ডলার।সব মিলিয়ে যুদ্ধোত্তর লুটের মোট হিসাব দাঁড়ায় ৫০০০ কোটি টাকা, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।সূত্র: জনতার মুখপাত্র,১ নভেম্বর ১৯৭৫।এই অঙ্ক কোনো আবেগ নয়-এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষতির হিসাব। সীমান্ত খুলে দিয়ে চোরাচালানের রাষ্ট্রীয় অনুমোদন যুদ্ধের পর সীমান্তের ১০ মাইল এলাকা ট্রেডের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এর ফল কী হয়েছিল?চোরাচালানের মুক্ত এলাকা।বাংলাদেশের সম্পদ নির্বিঘ্নে পাচার।সূত্র: আবুল মনসুর আহমদ,আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর।
এটি ছিল একটি অর্থনৈতিক করিডোর,যার একমুখী ট্রাফিক-বাংলাদেশ থেকে ভারতে।জাল টাকার আগ্রাসন: অর্থনীতির নীরব হত্যা ভারতে ছাপানো বাংলাদেশি জাল টাকা দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল-এ অভিযোগও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ নিজেই বলতে বাধ্য হয়েছিলেন:
জালনোট আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে।সূত্র: আব্দুর রহিম আজাদ,৭১-এর গণহত্যার নায়ক কে।এটি কোনো সীমান্ত চোরাচালান নয়-এটি ছিল মুদ্রাসন্ত্রাস।পরিত্যক্ত সম্পত্তি ও শিল্পকারখানার হরিলুট ১৯৭১-এর অবাঙালীদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি-রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষিত হওয়ার কথা থাকলেও-হয় হরিলুটের শিকার।
সূত্র:এম.এ.মোহায়মেন।জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি থেকে কোটি কোটি টাকার অস্ত্র নির্মাণের যন্ত্রপাতি ভারতে স্থানান্তর-এ তথ্যও অস্বীকৃত নয়।সূত্র:অলি আহাদ।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্ণনা তো আরও নগ্ন-ঢাকার রেফ্রিজারেটর, টিভি,কার্পেট ভর্তি ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় সৈন্যরা। শিমলা চুক্তি:তিন শিকার এক গুলিতে পাকিস্তানকে পরাজিত করে ভারত যা করলো-কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিকীকরণ ঠেকালো,
পাকিস্তানকে কব্জায় রাখলো,বাংলাদেশকে আজীবন দুর্বল
;নিরস্ত্র ও নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করলো।এটাই ছিল ৭১-এর প্রকৃত ট্রামকার্ড।
বিদ্রোহ,দমন ও ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই লুট রক্ষা করতেই অস্ত্র জমা না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ বিদ্রোহ করেছিল।এর ফল-কথিত আছে ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিহত বা গুম।এই অধ্যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও অস্বীকৃত,কিন্তু ইতিহাসে মুছে যায়নি।আজকের প্রেক্ষাপট:নতুন লুট,নতুন প্রভু আজ দৃশ্যপট বদলেছে,কিন্তু কাঠামো নয়।ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাসী সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা।নির্বাচন,অর্থনীতি,সংস্কৃতি-সবখানেই বহিরাগত স্বার্থের হস্তক্ষেপ।
প্রশ্ন একটাই-এবার কত রক্ত ঝরবে?
আর কতদিন মানুষ জেগে জেগে ঘুমাবে?করণীয়: আবেগ নয়, রাষ্ট্রচিন্তা এটি কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় ঘৃণার আহ্বান নয়।এটি একটি রাষ্ট্রকে রক্ষার রাজনৈতিক আহ্বান বাংলাদেশের জনগণকে ঠিক করতে হবে-ভোট কার স্বার্থে?নির্বাচন কার পছন্দে?রাষ্ট্র কার নিয়ন্ত্রণে?সময় থাকতে জেগে ওঠার বিকল্প নেই।ইতিহাস প্রমাণ করেছে-যে জাতি হিসাব চায় না,সে জাতি বারবার লুট হয়।বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে বাংলাদেশকেই আগে ভাবতে হবে।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক:নবজাগরণ
অনলাইনে পড়ুন: www.thenabajagaran.com





