মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশ বহুধর্মীয় সামাজিক ঐক্য, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ঐতিহাসিক চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশ। এখানে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু এবং মুসলিম-প্রতিটি ধর্মের মানুষ হাজার বছরের সহাবস্থানে একে অন্যের উৎসব-অনুষ্ঠানে শামিল হওয়া, সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো-এইটাই ছিল আমাদের আত্মার পরিচয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ইসকন নামক একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলেই জনমনে অস্বস্তি, বিতর্ক ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
প্রথমেই স্পষ্ট করে বলা দরকার-ইসকন কোনো “হিন্দুধর্ম” নয়, এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় ও চর্চাকে ইসকনের সাথে মিলিয়ে দেখেন না।বরং বহু হিন্দু নাগরিক প্রকাশ্যে বলেছেন-তাদের ধর্ম শান্তি, মানবপ্রেম ও পূজার ওপর দাঁড়ানো; সেখানে ইসকন প্রায়শই রাজনৈতিক প্রচার, সংগঠিত দখল ও বিভেদ তৈরির মাধ্যমে সম্প্রীতি নষ্ট করে-এ অভিযোগ বহুদিনের।
ধর্ম’ নাকি ‘কার্যক্রম’?-প্রশ্ন এখানেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। মানুষের উদ্বেগ সেই সংগঠনকে নিয়ে-যে ধর্মের নামে ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা বিদেশি স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।এখানে প্রশ্ন উঠছে-ইসকনের অর্থায়ন কোথা থেকে আসে? কারা মাঠে নেতৃত্ব দেয় এবং তাদের আন্তর্জাতিক সংযোগ কোথায়? কেন তাদের কার্যক্রম অনেক জায়গায় স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম উভয়ের সাথে সংঘাত সৃষ্টি করছে? কেন সীমান্ত অঞ্চলগুলোতেই তাদের তৎপরতা বেশি-এটা কি কাকতালীয়? এই প্রশ্নগুলো সরকার ও সমাজ উভয়ের জন্যই গুরুত্বের আলোচ্য বিষয়।
স্থানীয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর অবস্থান বাংলাদেশের প্রকৃত হিন্দু সম্প্রদায় ইসকনকে তাদের ধর্মীয় প্রতিনিধিত্ব হিসেবে দেখে না-এটা এখন প্রকাশ্য সত্য। অনেক হিন্দু পুরোহিত, গবেষক,পূজা কমিটির নেতা বলেছেন:“ইসকন রাসায়নিকভাবে আমদানি করা ধর্মীয় ফ্রেমওয়ার্ক।”এটি লোকায়ত বাঙালি হিন্দুধর্মের সংস্কৃতি, গান,পূজা-পার্বণ ও দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক।”অর্থাৎ ইসকন হিন্দু সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ ঐতিহ্যকেও অস্বীকার করে।
সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভাঙার ঝুঁকি
বাংলাদেশের মানুষ জানে-সম্প্রীতি নষ্ট করা মানে রাষ্ট্র দুর্বল করা যদি কোনো সংগঠন-ধর্মীয় পরিচয়কে ঢাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে তলোয়ার এবং বিদেশি কৌশলকে পরিকল্পনা বানিয়ে জনগণকে বিভক্ত করার চেষ্টা করে -তাহলে সেটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন।
ইঞ্জিনিয়ার থোহাই চিং মং শাক-একটি যুক্তির মুখ
পার্বত্য অঞ্চল ও মফস্বল এলাকাসহ দেশব্যাপী আলোচনায় যিনি বিষয়টি বাস্তব যুক্তি, বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এবং শান্ত মনোভাবের সাথে তুলেছেন-তিনি ইঞ্জিনিয়ার থোহাই চিং মং শাক।তিনি একজন উপজাতি যুবক, দেশপ্রেমিক এবং সম্প্রীতি রক্ষার সাহসী কণ্ঠ।
তার বক্তব্যের সারকথা:“যারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে ইসকনকে ঢাল দিচ্ছে – তারাই বরং ধর্মের নামে ভারতীয় গোয়েন্দা ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ককে বাংলাদেশের ভেতরে স্থাপন করতে চায়।”তিনি বলেন, “হিন্দু ভাইদের ধর্ম নিরাপদ থাকুক-কিন্তু ইসকন নামক সংগঠনকে আইন ও নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাচাই করা হোক।”
তার বক্তব্য কঠোর নয়-দায়িত্বশীল।কারণ এটা ধর্ম নয়,রাষ্ট্র ও সমাজের নিরাপত্তার প্রশ্নে তাহলে করণীয় কী? (রাষ্ট্রের পথে নীতিগত সমাধান)ক্ষেত্র সুপারিশ তদন্ত ইসকনের অর্থায়ন, নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ ও বিদেশি যোগাযোগ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খোলামেলা তদন্ত। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত হিন্দু ধর্মীয় আচার নিষিদ্ধ নয়-কিন্তু বিদেশি সংগঠনের রাজনৈতিক এজেন্ডা নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।
নিবন্ধন যাচাই তাদের এনজিও ও ধর্মীয় ট্রাস্ট রেজিস্ট্রেশন পুনঃনিরীক্ষা। কমিউনিটি ডায়লগ স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম নেতাদের সমন্বয়ে সম্প্রীতি পর্যবেক্ষণ বোর্ড গঠন।
স্বচ্ছতা প্রকাশ সরকারি তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ -যাতে বিভ্রান্তি না থাকে।
বাংলাদেশের পরিচয় মানবিকতা, শান্তি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
এখানে ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করে না-ধর্ম মানুষকে কাছে আনে।তাই-ধর্মকে ঢাল করে যদি কোনো সংগঠন রাজনৈতিক বা ভূ-কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহৃত হয়-তবে রাষ্ট্র নীরব থাকতে পারে না।আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে নই,আমরা সন্ত্রাস, বিভাজন ও বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ একদিনে গড়া হয়নি-এ দেশের মাটিতে বাঙালি, আদিবাসী, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ-সবাইয়ের রক্ত মিশে আছে।এই সম্প্রীতি রক্ষা করা আমাদের নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব।
লেখক:মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-নবজাগরণ
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com





