দেশের সার্বভৌমতা ও মানবাধিকারের পক্ষে এক নীতিগত অবস্থান-আবেগ নয়, ন্যায়ের আলোয় সিদ্ধান্ত নিন।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
ভারতীয় ঔদ্ধত্য ও বাংলাদেশের স্বার্থ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চান্ন বছর পরও প্রতিবেশী ভারতের আচরণে ঔপনিবেশিক মানসিকতার গন্ধ যায় না। কথায় কথায় “বন্ধুপ্রতিম দেশ” বলে সান্ত্বনা দিলেও বাস্তবে দেখা যায়,প্রতিটি রাজনৈতিক সংকট,অর্থনৈতিক নীতি, এমনকি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক প্রশ্নেও ভারত যেন এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে একতরফা নদী বাঁধ, সীমান্তে হত্যা, পণ্য রপ্তানিতে অস্থিরতা, এমনকি রাজনৈতিক দলের ভিতর-বাহিরে প্রভাব খাটানো-সব কিছুই সেই ঔদ্ধত্যের বহিঃপ্রকাশ।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের হাতে রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক বক্তা ড. জাকির নায়েককে সম্মানিত নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিটি কেবল ধর্মীয় আবেগ নয়-এটি এক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জবাবও বটে। যে ভারত আজও নিজের সংবিধান ও মানবাধিকার পদদলিত করে মুসলিম বিদ্বেষের রাজনীতি চালাচ্ছে,তাকে প্রতিহত করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হলো-ন্যায়, স্বাধীনতা ও মানবতার ভিত্তিতে প্রতিরোধ গড়া।
কে ড.জাকির নায়েক? বিতর্ক,অবদান ও আন্তর্জাতিক অবস্থান-ড.জাকির নায়েক কোনো সন্ত্রাসী নন। কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলেননি। বরং তিনি এমন এক সুবক্তা, যিনি যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকে ইসলাম ব্যাখ্যা করে আধুনিক প্রজন্মকে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত Peace TV একসময় বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের কাছে সত্য, যুক্তি ও ইসলামিক চিন্তার বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তাই একসময় ভারতের শাসকশ্রেণির চোখে গাঁথা হয়ে যায়। কারণ ড.নায়েক কখনোই ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি বলেছিলেন-“ধর্ম নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও।” অথচ আজ সেই কথাগুলোই তাকে “অপরাধী” বানিয়ে দিয়েছে।
২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজান হামলার পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়া একযোগে জাকির নায়েকের নাম জড়ায়। অথচ কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই-কোনো আদালতও তাকে দোষী ঘোষণা করেনি। পরে মালয়েশিয়া সরকার তাকে আশ্রয় দেয়, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ভারতীয় অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবিত’ বলে অভিহিত করে।
তবু ভারত আজও চাপ দিয়ে যাচ্ছে-“নায়েককে আমাদের হাতে তুলে দাও।”কেন? কারণ তিনি মুসলিম, কারণ তিনি যুক্তির ভাষায় ইসলাম ব্যাখ্যা করেন,এবং কারণ তিনি ভারতের ইসলামভীতির সামনে নির্ভয়ে কথা বলেন।
বাংলাদেশের সামনে নৈতিক ও কূটনৈতিক প্রশ্ন
বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এটি এখন একটি মৌলিক প্রশ্ন-আমরা কি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অন্যায়ের দাবিতে মাথা নত করবো,নাকি ন্যায় ও মানবতার পক্ষে দাঁড়াবো?
যখন কোনো দেশ একজন মানুষকে“বক্তৃতার অপরাধে” নির্বাসিত করে, তখন সেটি কেবল ব্যক্তিগত নিপীড়ন নয়-এটি চিন্তা, বিশ্বাস ও বক্তব্যের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। বাংলাদেশ যদি সেই স্বাধীনতার পক্ষে থাকে, তবে জাকির নায়েককে আশ্রয় ও সম্মান দেওয়া একেবারেই ন্যায্য।কেউ যদি বলেন, “তিনি বিতর্কিত”-তাহলে জিজ্ঞাসা করা যায়, কাদের কাছে বিতর্কিত? ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া? নাকি সেই রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যারা মুসলমানদের ইতিহাসই মুছে দিতে চায়? বিতর্কের সংজ্ঞা কখনোই অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
ভারতের দ্বিচারিতার নমুনা ও প্রতিবেশী চাপ
ভারত যে দ্বিচারিতা দেখায়, তার নজিরও কম নয়।
বাংলাদেশে হাজারো অপরাধী,ঘাতক,জালিয়াত ও দালাল আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। এদের বিরুদ্ধে বারবার অনুরোধ জানানো হলেও ভারত কাউকেই ফেরত দেয়নি। আবার নিজের নাগরিক বা রাজনৈতিকভাবে অপ্রিয় মুসলমানকে ফেরত চায় “সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে”।এই অন্যায় নীতি কূটনীতির সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা গেছে-বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত প্রায়ই অনধিকারচর্চা করে এসেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা ইস্যু, সীমান্ত চুক্তি-সবক্ষেত্রেই ভারতীয় স্বার্থকে বাংলাদেশের স্বার্থের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে।আজ যখন বাংলাদেশ নতুনভাবে নিজের সার্বভৌমত্ব পুনর্গঠন করছে, তখন ভারতের এই অহঙ্কারকে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিরোধ করা সময়ের দাবি।এবং সেই প্রতিরোধের প্রতীক হতে পারেন ড.জাকির নায়েক-যিনি যুক্তি,ইসলাম ও মানবতার পক্ষে কথা বলেন।
নাগরিকত্ব কি প্রতিরোধের সেরা হাতিয়ার?
বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতি আজ একটাই:আমাদের দেশের সিদ্ধান্ত হবে আমাদের নিজের হাতে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বা দিল্লির আমলারা আমাদের রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবে না।যদি কোনো ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা বা দূতাবাসের কেউ ড. জাকির নায়েককে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ বা পরামর্শ দেয়-তাহলে সেটি আমাদের জাতীয় মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত।একজন বিদেশি বক্তা, যিনি কোনো অপরাধে অভিযুক্ত নন,তাকে বিদেশি সরকারের “ইচ্ছার কারণে” হস্তান্তর করা মানে হলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেওয়া।
আমরা ভুলে যাই না-যে ভারত আজ গৌতম আদানির করপোরেট সাম্রাজ্য রক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকেও অর্থনৈতিকভাবে অধীন করে রাখতে চায়,সেই ভারতকে কখনোই বিনা প্রতিবাদে নতজানু হতে দেওয়া যায় না।
ড.নায়েককে সম্মানিত নাগরিকত্ব দেওয়ার অর্থ হবে-বাংলাদেশ আর কোনো বিদেশি আধিপত্য মানবে না।
প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া-আইনি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ-এখন প্রশ্ন আসবে-“জাকির নায়েককে নাগরিকত্ব দিলে কি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়বে?”উত্তর হলো-না, যদি আমরা যুক্তি ও নীতির ভিত্তিতে দাঁড়াই। মালয়েশিয়া যেমন দিয়েছে আশ্রয়,তেমনি তুরস্ক, কাতার,ইন্দোনেশিয়া থেকেও তিনি সম্মান পেয়েছেন। কোনো দেশই তাদের নীতি ব্যাখ্যা দিতে লজ্জিত হয়নি,বরং বলেছে-‘বক্তব্যের স্বাধীনতা আমাদের মৌলিক মূল্যবোধ।’
বাংলাদেশও বলতে পারে-“আমরা কোনো অপরাধীকে নয়, একজন চিন্তাবিদকে সম্মান দিচ্ছি।”এটি ইসলামপন্থী কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রশ্ন নয়-এটি ন্যায়ের প্রশ্ন, মানবাধিকারের প্রশ্ন,এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রশ্ন।
ভারতপন্থী দালালচক্র ও জাতীয় স্বার্থের বিঘ্ন
দেশে এখনো বহু “ভারতপন্থী নেতা” ছড়িয়ে আছে, যারা নিজেদের রাজনৈতিক বেঁচে থাকার জন্য ভারতীয় স্বার্থে কাজ করে। এই “ভারতীয় দালালচক্র” হলো বাংলাদেশের প্রকৃত শত্রু।এরা একদিকে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, অন্যদিকে ভারতের চোখে নিজেদের প্রমাণ করতে মরিয়া থাকে।এরা এখন বলবে-“জাকির নায়েককে আশ্রয় দিলে ভারত রুষ্ট হবে।”প্রশ্ন হলো-আমরা কি ভারতের রুষ্ট হওয়ার ভয়েই ন্যায়, মানবতা ও ইসলামের প্রতি দায়িত্ব ভুলে যাব?
বাংলাদেশের জনগণ আজ জানে-যারা ভারতের তোষণনীতিতে বিশ্বাস করে,তারা আসলে নিজেদের জনগণকে বিশ্বাস করে না।এই কারণেই আজ সময় এসেছে-রাষ্ট্রের প্রতিটি নীতি পুনর্মূল্যায়ন করার; দেখতে হবে কারা আসলে বাংলাদেশের স্বার্থের পাশে, আর কারা ভারতের পায়ের তলায়।
এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত,এক জাতির বার্তা-আন্তর্জাতিক প্রভাব ড.জাকির নায়েককে সম্মানিত নাগরিকত্ব দেওয়ার মধ্যে কেবল একটি মানুষকে রক্ষা করা নয়-এটি হবে নতুন বাংলাদেশের নৈতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক।জুলাই বিপ্লবের পর যে “জনগণের সরকার” নতুন রাষ্ট্রচেতনা প্রতিষ্ঠা করছে, সেখানে এই পদক্ষেপের অর্থ হবে-বাংলাদেশ কোনো বৈদেশিক চাপ বা ধর্মভিত্তিক বিভাজনকে ভয় পায় না।
এটি হবে মানবতার পক্ষে এক অবস্থান।
যেদিন কোনো রাষ্ট্র সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে শেখে, সেদিনই সে রাষ্ট্র পরিণত হয় সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্রে।ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে আজ সুযোগ আছে ইতিহাসে নাম লেখানোর-বাংলাদেশের ভূমি যেন মানবতার আশ্রয়স্থল হয়, ভয় নয়।
নতুন বাংলাদেশ,নতুন মর্যাদা
বাংলাদেশের জনগণ এখন নতজানু নয়, স্বাধীন।
আমরা জানি, ভারতের দালালচক্র চুপ থাকবে না, কিন্তু আমাদের প্রতিক্রিয়া হবে জ্ঞান ও নীতির ভাষায়।
যে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা মনে করে বাংলাদেশ এখনো তাদের করিডর রাজনীতির অংশ,তাদের আমরা জানিয়ে দিতে চাই-এখানে এখন নতুন বাংলাদেশ, নতুন সরকার, নতুন চেতনা। জাকির নায়েককে সম্মানিত নাগরিকত্ব দেওয়া মানে-এটি শুধু একজন বক্তাকে সম্মান নয়,এটি স্বাধীনতার ঘোষণা, ন্যায়ের বিজয়,এবং দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের সূচনা।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক:নবজাগরণ
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com





