মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠনের নাম নোয়াখালী জেলা সমিতি, ঢাকা। শতাধিক বছরের ইতিহাসে এটি কেবল একটি প্রবাসী সমিতি নয়, বরং একটি আন্দোলনের নাম-একটি ঐক্যের প্রতীক, একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিষ্ঠান। এই সমিতির বয়স এখন ১২০ বছরেরও বেশি। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এটি নোয়াখালীর মানুষের সামাজিক সংহতি, শিক্ষার বিস্তার, সাংস্কৃতিক বিকাশ ও সমাজসেবার অনন্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন জনপ্রিয় সংগঠক এম এ খান বেলাল, এবং সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সেনবাগের কৃতিসন্তান, বাংলাদেশ পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি জনাব আবদুল মাবুদ দুলাল। এই নির্বাচন কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঘটনা নয়, বরং নোয়াখালী জেলা সমিতির ১২০ বছরের ঐতিহ্য পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
ঐতিহ্যের শিকড়: এক প্রবাসী সংগঠনের জন্ম
উনিশ শতকের শেষ ভাগে নোয়াখালী তখন ছিল উপকূলীয় ও পশ্চাৎপদ জনপদ। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য অনেকেই ঢাকায়, কলকাতায় ও চট্টগ্রামে পাড়ি জমাতেন। অচেনা নগরজীবনে প্রবাসী নোয়াখালীবাসীরা দ্রুত বুঝতে পারেন-তাঁদের টিকে থাকা, এগিয়ে যাওয়া এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন।
এই প্রয়োজন থেকেই জন্ম নেয় নোয়াখালী জেলা সমিতি।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম, শিক্ষার প্রসার-এসব ক্ষেত্রেই নোয়াখালীবাসী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। নোয়াখালী জেলা সমিতির অনেক সদস্য ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা, মুক্তিকামী তরুণ, পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সংগঠক।
অতীতের গৌরব ও সংকট সাফল্যের ধারাবাহিকতা
অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান। দুঃস্থ ও অসহায়দের জন্য চিকিৎসা সহায়তা। নোয়াখালীর সংস্কৃতি, লোকসংগীত, নাটক ও সাহিত্যকে ঢাকার মঞ্চে তুলে ধরা।
জাতীয় পর্যায়ে নোয়াখালী জেলার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একত্রিত করার প্ল্যাটফর্ম। সংকট ও স্থবিরতা কিন্তু সব সাফল্যের পরও সমিতি ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব আর আঞ্চলিক বিভাজন সমিতিকে দুর্বল করেছে। রাজনৈতিক প্রভাব-জাতীয় রাজনীতির নেতারা নিজেদের প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কার্যক্রমে অনিয়ম-শিক্ষা ও সমাজসেবা কেন্দ্রিক প্রকল্পে ধারাবাহিকতা ছিল না।
তরুণ প্রজন্মের অনাগ্রহ -নতুন প্রজন্ম মনে করেছে এটি কেবল প্রবীণ ও প্রভাবশালী মহলের আড্ডাস্থল।
ফলে সমিতি তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়।
এবারের নির্বাচন:ঐতিহ্যের নবজাগরণের ডাক
২০২৫ সালের নির্বাচন তাই অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সভাপতি এম এ খান বেলাল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাবুদ দুলালের নেতৃত্বে প্রবাসী নোয়াখালীবাসী আশা করছে-এবারের নির্বাচন হবে ঐক্যের নতুন সূচনা।
এম এ খান বেলাল-
তিনি দীর্ঘদিন ধরে নোয়াখালী জেলা সমিতির কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন। সহজ-সরল ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। তাঁর নির্বাচিত হওয়া মানে অভিজ্ঞ সংগঠক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা।
আবদুল মাবুদ দুলাল-
সেনবাগের সন্তান, বর্তমানে পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ঢাকা রেঞ্জ)। প্রশাসনিক দক্ষতা, সৎ চরিত্র ও মানবিক গুণাবলীর জন্য তিনি পরিচিত। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর নির্বাচিত হওয়া প্রমাণ করে-প্রবাসী সমাজ এখন কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং দক্ষ প্রশাসনিক নেতৃত্বকেও চাইছে।
প্রবাসী নোয়াখালীবাসীর প্রত্যাশা
১. ঐক্য সংহতকরণ-ঢাকায় প্রায় ৩০-৪০ লাখ নোয়াখালীবাসী। তাঁদের এক প্ল্যাটফর্মে আনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
২. জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা -অতীতে আর্থিক কার্যক্রম ছিল অস্বচ্ছ। প্রত্যাশা-এবার প্রতিটি আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ পাবে।
৩. সদস্যপদ উন্মুক্তকরণ -দীর্ঘদিন ধরে নতুন সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছিল না। তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করাই এখন জরুরি।
৪. শিক্ষা ও সমাজসেবা-
গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি।
চিকিৎসা সহায়তা প্রকল্প।
নোয়াখালীর উন্নয়নমূলক কাজে সমর্থন।
৫. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ -নোয়াখালীর গান, নাটক, ভাষা ও লোকসংস্কৃতি প্রবাসী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
৬. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম -অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, ওয়েবসাইট, অ্যাপ-যাতে প্রবাসী নোয়াখালীবাসীরা যেখানেই থাকুক, যুক্ত হতে পারে।
বিজিত প্রার্থীদের প্রতি বার্তা-
যারা নির্বাচিত হতে পারেননি, তাঁদের প্রতিও শুভেচ্ছা। এটি কোনো চূড়ান্ত পরাজয় নয়, বরং বড় বিজয়ের জন্য প্রাথমিক পরীক্ষা। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক ভবিষ্যতের সংগঠনে বড় সম্পদ হতে পারে।
ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ
১. রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি
নোয়াখালী জেলা সমিতি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। নতুন নেতৃত্বকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
২. গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিরসন
অতীতের বিভাজন নতুন নেতৃত্বকে ঐক্যের মাধ্যমে দূর করতে হবে।
৩. আধুনিকীকরণ
ডিজিটাল ভোটিং, অনলাইন রিপোর্ট প্রকাশ-এসব প্রবাসী সংগঠনের আধুনিক রূপ তৈরি করবে।
৪. প্রবাসী সংযোগ
শুধু ঢাকাই নয়, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকার নোয়াখালীবাসীকেও যুক্ত করতে হবে।
৫. নিয়মিত কর্মসূচি
শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি ও সমাজসেবায় ধারাবাহিক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।
নোয়াখালী সমিতির সামাজিক প্রভাব: ইতিহাসের সাক্ষ্য
এই সমিতি অতীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন অনেক গুণী মানুষ-শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তাঁদের কারণে নোয়াখালী জেলা সমিতি ঢাকার সামাজিক পরিমণ্ডলে একটি সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল।
আজও যদি সমিতি তার পূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে, তবে এটি জাতীয় উন্নয়নেরও সহায়ক হতে পারে।
একটি নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি আজ নোয়াখালী জেলা সমিতি এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। অতীতের গৌরবকে পুনর্জাগরণ করে, বিভাজন ও স্থবিরতার অন্ধকার কাটিয়ে এটি নতুন ভোরের সূচনা করতে পারে।
এম এ খান বেলাল ও আবদুল মাবুদ দুলালের নেতৃত্বে যদি-
ঐক্য গড়ে তোলা যায়,জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়,
তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করা যায়,
প্রবাসী সমাজকে কার্যকরভাবে সংহত করা যায়-
তাহলে এই নেতৃত্ব সত্যিই হয়ে উঠবে নোয়াখালী সমাজের নবজাগরণের দূত।
প্রশ্ন একটাই-তাঁরা কি এই ঐতিহ্যকে পুনর্জাগরণে রূপ দিতে পারবেন? সময়ই সেই উত্তর দেবে।
লেখক: মো: আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে www.thenabajagaran.com