নবজাগরণ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশ-যে দেশ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, ইতিহাসের গৌরব এবং সংস্কৃতির ঐশ্বর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার এক অনন্য ভূখণ্ড হিসেবে, সেই দেশ আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিহ্নিত হচ্ছে অনিরাপদ ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে।
আমরা গর্ব করি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার নিয়ে, গর্ব করি সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে, গর্ব করি সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্য কিংবা সিলেটের পাহাড়-চা বাগান নিয়ে। অথচ বাস্তবতা হলো-বিদেশি পর্যটকের চোখে বাংলাদেশ এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে।
সাম্প্রতিক দুই ঘটনা: অ্যালার্ম বেল
সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা পুরো বিষয়টিকে নতুন করে সামনে এনেছে। প্রথমত, জাপানের কিছু জনপ্রিয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বাংলাদেশ সফরের পর তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে সরাসরি লাইভে এসে বলেছেন-“বাংলাদেশ ভ্রমণ করবেন না।” তাদের অভিযোগ-নারী পর্যটকরা যৌন হয়রানির শিকার হন,মোবাইল, টাকা, ক্যামেরা ছিনতাই হয়,সাধারণ নাগরিকরা অযথা বিরক্ত করেন,দোকানিরা ৩-৪ গুণ দাম দাবি করেন,সমুদ্রসৈকতে নারীদের ভিডিও তুলে সামাজিক মাধ্যমে অশালীনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
তাদের এই ভিডিও মুহূর্তেই ভাইরাল হয়, এবং আরও অনেক বিদেশি পর্যটক সেই লাইভে তাদের নিজস্ব ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। দ্বিতীয়ত, রংপুর ভ্রমণে আসা এক ইরানি দম্পতি স্থানীয় ছিনতাইকারীর হাতে পড়েন। তাদের মোবাইল ও টাকা লুট হয়ে যায়। যদিও পুলিশ পরে উদ্ধার করে, কিন্তু বিদেশি দম্পতির মনে যে আতঙ্ক তৈরি হলো তা কি উদ্ধার করা গেল? এই দুটি ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন নয়; বরং বাংলাদেশের পর্যটন খাতের জন্য এক ভয়ংকর অ্যালার্ম বেল।
কেন বিদেশি পর্যটকরা আতঙ্কিত?
বিদেশি পর্যটকদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে কিছু সাধারণ অভিযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে-
১. যৌন হয়রানি ও অশোভন আচরণ
নারী পর্যটকরা প্রায়শই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। সমুদ্রসৈকতে, রাস্তার ভিড়ে, কিংবা পর্যটন এলাকায় অশালীন দৃষ্টি, ছবি তোলা, অনুসরণ করা-এসব ঘটনা বারবার ঘটছে।
২. চুরি ও ছিনতাই ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট-যেখানেই যান, বিদেশিদের লক্ষ্য করে ছিনতাইকারীরা সুযোগ নেয়।
৩. অতিরিক্ত দাম আদায়
ফুটপাত থেকে শুরু করে ছোট দোকান, রিকশা বা সিএনজি-সব জায়গায় বিদেশিদের কাছে তিন-চার গুণ দাম দাবি করা হয়।
৪. অযাচিত কৌতূহল-বাংলাদেশিদের আতিথেয়তা বিশ্বখ্যাত, কিন্তু যখন সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিরক্তিতে পরিণত হয়, তখন বিদেশিরা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করেন।
৫. গোপনীয়তা লঙ্ঘন-নারী পর্যটকদের গোপনে ভিডিও ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে অশালীন ক্যাপশনে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ বারবার হচ্ছে। এটি কেবল পর্যটনের ক্ষতি নয়, বরং দেশের সম্মানহানিও বটে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশ কোথায়?
আজকের বিশ্বে প্রতিটি দেশের ভ্রমণ নিরাপত্তা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করে। ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ব্রিটিশ ফরেন অফিস প্রায়ই তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে।
Lonely Planet, Tripadvisor বা Backpacker’s Guide-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতেও বাংলাদেশ ভ্রমণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান বা শ্রীলঙ্কায় প্রতিবছর লাখ লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে যান, অথচ বাংলাদেশে পর্যটক সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অতি নগণ্য।
প্রশ্ন হলো-কেন?উত্তর একটাই: নিরাপত্তাহীনতা ও আস্থার সংকট।কেন এটি ভয়ংকর সংকেত?বাংলাদেশের পর্যটন খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অপরিসীম।প্রতি বছর ১০-১২ মিলিয়ন বাংলাদেশি বিদেশে ভ্রমণ করেন। যদি সেই সংখ্যার অর্ধেক বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসতেন, তবে বছরে বিলিয়ন ডলার আয় হতো।
পর্যটনশিল্প প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারত।অথচ বর্তমানে পর্যটনের অবদান দেশের জিডিপিতে ৩ শতাংশেরও কম।
কারণ একটাই-বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরাপত্তাহীনতা।
যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তবে-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ট্রাভেল গাইডে “ঝুঁকিপূর্ণ দেশ” হিসেবে পরিচিত হবে,
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবেন,পর্যটননির্ভর ক্ষুদ্র ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে, এবং আমরা নিজেরাই নিজেদের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করব।
দায় কার?এখানে দায় তিন পক্ষের-
১. সরকারের ব্যর্থতা পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা, অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় না আনা, পর্যটকবান্ধব নীতি না থাকা-এসব রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।
২. ব্যবসায়ীদের অসততা:দোকানি, রিকশাওয়ালা, ট্যাক্সিচালক-বিদেশিদের ঠকানো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
৩. সমাজের মানসিকতা:অতিথিকে সম্মান না করে তাদেরকে অশোভন কৌতূহল ও হয়রানির শিকার করা আমাদের সামাজিক ব্যর্থতা।
সমাধান কীভাবে সম্ভব?
১. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ: পর্যটন এলাকায় ট্যুরিস্ট পুলিশ ইউনিট শক্তিশালী করতে হবে।প্রতিটি পর্যটন স্পটে সিসি ক্যামেরা ও হেল্পডেস্ক থাকতে হবে। বিদেশিদের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার। অপরাধীদের দৃশ্যমান শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. ব্যবসায়িক সংস্কার:পর্যটন এলাকায় “ফেয়ার প্রাইস শপ” চালু করতে হবে।দোকানিদের পর্যটক-বান্ধব আচরণের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।অতিরিক্ত দাম আদায় করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. সামাজিক সচেতনতা:স্থানীয় জনগণকে বুঝতে হবে-একজন পর্যটকের ভালো অভিজ্ঞতা মানে দেশের জন্য বিনিয়োগ। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে “ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি বাংলাদেশ” বিষয়ে পাঠ্যক্রম যুক্ত করা যেতে পারে।
গোপনে ছবি তোলা বা হয়রানিকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে প্রচার করতে হবে।
৪. প্রযুক্তির ব্যবহার:বিদেশি পর্যটকদের জন্য ২৪/৭ হেল্পলাইন অ্যাপ চালু করা দরকার। পর্যটন এলাকার জন্য বহুভাষিক তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। একটি ডিজিটাল মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: পর্যটন শিল্প উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন UNWTO, JICA, UNESCO-এর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোতে ট্যুরিজম প্রোমোশন সেল চালু করতে হবে।
এখনই না জাগলে কাল দেরি হয়ে যাবে
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এক বিশাল সম্ভাবনার ভাণ্ডার। কিন্তু সেই ভাণ্ডারকে আমরা নিজেরাই ধ্বংস করছি। ইরানি দম্পতির মতো ঘটনা, জাপানি অ্যাক্টিভিস্টদের সতর্কবার্তা-এসব উপেক্ষা করলে আগামী দিনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হবে “সৌন্দর্যে ভরা, কিন্তু অনিরাপদ” দেশ হিসেবে।
আমরা কি সেটা চাই? যদি না চাই, তবে এখনই বদলাতে হবে।রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব নিতে হবে,ব্যবসায়ীদের সততার পথে ফিরতে হবে, সমাজকে শিখতে হবে-অতিথি হলো মর্যাদা,অতিথি হলো ভবিষ্যৎ।
আমরা ভুলে গেলে চলবে না-
একজন বিদেশি পর্যটক যখন হাসিমুখে দেশে ফেরেন, তখন তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে ওঠেন। আর যখন আতঙ্ক নিয়ে ফেরেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের সবচেয়ে ভয়ংকর সমালোচক। অতএব-পর্যটকের হাসিমুখই আমাদের জাতীয় সম্মানের প্রতীক। এই সম্মান রক্ষা করাই এখন রাষ্ট্র ও সমাজের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে www.thenabajagaran.com