মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের নাম হয়তো পাঠ্যবইয়ে নেই, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের তালিকায়ও নেই, কিন্তু তাঁদের জীবন ও অবদান ছাড়া স্বাধীনতার ইতিহাসকে পূর্ণতা দেওয়া যায় না। সেনবাগ উপজেলার বীজবাগ ইউনিয়নের দক্ষিণ কাজিরখিল গ্রামে জন্ম নেওয়া ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবুল বাশার সেইসব মানুষের একজন, যিনি তরুণ বয়সে জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বাধীনতার পরও তিনি দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি-দেশের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় রেখেছেন এক অমোঘ ছাপ।
আজ তিনি সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টির পরিচালক (অপারেশন), ইসলামি ব্যাংক পিএলসির সাবেক ডিএমডি। কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয়-একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি অতীতের সাহসকে আজকের প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
শেকড় ও বেড়ে ওঠা: ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবুল বাশারের জন্ম নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার ৮নং বীজবাগ ইউনিয়নের দক্ষিণ কাজিরখিল (দক্ষিণ জয়নগর) গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও বনেদি পরিবার সৈয়দবাড়িতে। মরহুম সৈয়দ আবুল খায়ের এর ৬ পুত্র ও ৩ কণ্যার মধ্যে সৎ বিনয়ী মেধাবী সকলের বড় হচ্ছে ইন্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবুল বাশার।এই পরিবার শুধু সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়েও দেশপ্রেমিক ভূমিকার জন্য পরিচিত ছিল। গ্রামের কাঁচা রাস্তা, পুকুরপাড়, মাটির গন্ধ আর সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টই তাঁর শেকড়কে গড়ে তুলেছে। শৈশবেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন-দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে কেবল শিক্ষা, সততা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে।
মুক্তিযুদ্ধের আহ্বানে সাড়া: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের দমননীতি ও গণহত্যা যখন গোটা জাতিকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন তরুণ বাশারও ঘরে বসে থাকতে পারেননি। স্বাধীনতার ডাক তাঁর অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান এবং সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
সেনবাগ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব আবুল কালাম আজাদ তাঁর অবদান স্মরণ করতে গিয়ে বলেন-“ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবুল বাশার মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর অসামান্য অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন এক সাহসী তরুণ, যিনি অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি।”
এই বক্তব্য শুধু একজন মানুষের অবদানকে স্বীকৃতি নয়, বরং ইতিহাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা অনেক অজানা মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
যুদ্ধোত্তর জীবনে নতুন দায়িত্ব-স্বাধীনতার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধাই ব্যক্তিগত জীবনের সংগ্রামে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু আবুল বাশার ভিন্ন। তিনি বুঝেছিলেন, যুদ্ধ শেষ হলেও জাতি গঠনের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।
তিনি প্রকৌশল শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের জায়গায় উঠে আসেন। বিশেষ করে-ইসলামি ব্যাংক পিএলসি-তে ডিএমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন: যেখানে তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন, আধুনিকায়ন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করেছেন।
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টির পরিচালক (অপারেশন): এখানে তিনি উচ্চশিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নে অবদান রাখছেন। অর্থনীতি ও শিক্ষায় তাঁর অবদান দেখিয়ে দেয়-একজন মুক্তিযোদ্ধা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমেও জাতিকে এগিয়ে নিতে পারেন।
শিক্ষা ও নতুন প্রজন্মের জন্য বার্তা:সম্প্রতি এক ব্যক্তিগত সাক্ষাতে দেখা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে এসেও তিনি আগের মতোই একই মানুষ-আন্তরিক, স্নেহশীল ও উষ্ণ। এ দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, তাঁর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেই মূল উপাদান এখনো অটুট আছে।
তিনি আমাদের শেখান:তরুণদের হাতে দেশকে তুলে দিতে হবে শিক্ষা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। মুক্তিযুদ্ধ মানে কেবল অতীতের বীরত্ব নয়; এটি আজকের সুশাসন, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার দাবি। যুদ্ধে অস্ত্র ছিল হাতিয়ার, কিন্তু আজ শিক্ষাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
আজকের বাংলাদেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতি
আজ যখন আমরা দেখি দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি, শিক্ষায় বৈষম্য আর রাষ্ট্রীয় অনিয়ম-তখন প্রশ্ন জাগে, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন কোথায় হারাল? ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবুল বাশারের মতো মানুষরা দেখিয়েছেন, কীভাবে সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একদিনের ঘটনা নয়, এটি একটি চলমান সংগ্রাম। দুর্নীতি, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ আজও চলছে।
বিপ্লবী আহ্বান:আমরা যদি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হই, তবে আমাদের সামনে তিনটি দায়িত্ব রয়েছে:
১. মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রেরণা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
২. শিক্ষা ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করা।
৩. দুর্নীতি, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে নতুন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবুল বাশার আমাদের মনে করিয়ে দেন-“মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয় না; শুধু তার রূপ বদলায়।”
ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবুল বাশারের জীবনের গল্প আমাদের শেখায়, ইতিহাসের প্রকৃত বীররা শুধু যুদ্ধে অংশ নেন না, যুদ্ধ শেষে জাতিকে গড়ে তোলার জন্যও নিরলসভাবে কাজ করেন।
আজকের বাংলাদেশে যখন তরুণরা হতাশ, দিশেহারা ও বিভক্ত, তখন তাঁর মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনই হতে পারে অনুপ্রেরণার বাতিঘর।
আমরা যদি তাঁর আদর্শকে ধারণ করি, তবে স্বাধীনতার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো একদিন বাস্তবায়িত হবে। তখনই বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের মুক্তির দেশ-একটি শিক্ষিত, সুশাসিত ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ-ছবি:মো:আফনান পাটোয়ারী নুভান
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com