স্বাধীনতার রক্তরং:কারা লুকিয়ে রাখলো বাংলাদেশের আসল ইতিহাস?

লেখক:মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
১৯৪৭ সালের আগস্ট। উপমহাদেশের মানচিত্রে এক বিভাজন রচিত হলো, কিন্তু সেটি শুধু ভূখণ্ডের নয়-অর্থনীতি, ক্ষমতা ও শ্রেণি-বিন্যাসেরও।পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এক বিশাল আর্থিক ও রাজনৈতিক শক্তি হারিয়ে বসে হিন্দু জমিদার শ্রেণি। পূর্ব বাংলার হাজার বছরের জমি-জমা, বাণিজ্যিক শিকড়, ও প্রশাসনিক প্রভাব হারিয়ে তারা সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। এই শ্রেণিই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের পরিকল্পিত শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।

ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা: ১৯৪৭-১৯৭১
পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নিলেও,তার শত্রু তখনই জন্ম নেয় দিল্লি ও কলকাতার বৈঠকখানায়।১৯৪৭-৪৮ সালে কাশ্মীর বিভক্তি, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ,তাসখন্দ চুক্তি-সবকিছুতেই ভারতের লক্ষ্য ছিল একটি:“পাকিস্তানকে ভিতর থেকে ভাঙা”।এবং সেই ভাঙনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় ছিল-পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া।

১৯৭১ সালে তারা সেই পরিকল্পনার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন করলো। যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা একদল বাঙালি সেনা, সাধারণ মানুষ ও ছাত্রসমাজ; কিন্তু যুদ্ধের ক্রেডিট কে নিল?ভারত।আর ইতিহাসে নাম হলো-Indo-Pak War!কিন্তু যে যুদ্ধের কবরের মাটি ভেজা ছিল লক্ষ বাঙালির রক্তে, সেখানে ভারতীয় সেনারা সিঁদুর লাগিয়ে ছবি তুলল, নাম দিল অপারেশন সিঁদুর।সত্যি, ইতিহাস কখনও শুধু লেখা হয় না-লুটে নেওয়া হয়।

হায়দরাবাদ, সিকিম আর বাংলাদেশ:এক কৌশলগত নকশা-ভারতের কৌশল স্পষ্ট ছিল।যেভাবে হায়দরাবাদের নিজামকে সামরিক শক্তি দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল, সেভাবেই সিকিমকে ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রীয় দখলে নিল-বাংলাদেশকেও তারা একই কৌশলে “নরম দখল” করেছে।

সেনাবাহিনী পাঠানোর দরকার হয়নি;বরং একদল “দেশদ্রোহী” রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী শ্রেণির মাধ্যমে ভারতের স্বার্থই হয়ে উঠলো বাংলাদেশের নীতি।ভারতের কোম্পানি, ভারতীয় কনটেন্ট, ভারতীয় বাণিজ্য-সব কিছু “বন্ধুত্ব” নামের মোড়কে ঢুকে গেল।বাংলাদেশের নদী মরে গেল, সীমান্তে লাশ পড়ল, পানি দিয়ে ভাসিয়ে দিল লক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষকে, আর আমরা “মৈত্রী” বলে হাততালি দিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের লুটেরা ইতিহাস:বাংলাদেশের রক্তমাখা স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, তার নাম দিল “ভারতের সামরিক বিজয়”।পাকিস্তান যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতকে লাল পতাকা দেখাচ্ছিল, তখন দিল্লির টেবিলে লেখা হচ্ছিল-কীভাবে পাকিস্তান ভেঙে দেওয়া হবে এবং কীভাবে নতুন রাষ্ট্রকে “ভারতীয় নির্ভরশীল” রাখা যাবে।স্বাধীনতার পর পাকিস্তান রেখে যাওয়া অস্ত্র, সরঞ্জাম, কারখানা, গুদাম-সব কিছু লুট হয়ে গেল।কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর লুট হলো চেতনার।যে মুক্তিযুদ্ধ এক জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক ছিল, সেটিকে বানানো হলো এক “কৃতজ্ঞতার ইতিহাস”,যেন আমরা ভারতের দাস হয়ে জন্মেছি।

৫৪ বছরের পরিণতি:স্বাধীনতা শুধু কাগজে
আজ ৫৪ বছর পর,ভারত বাংলাদেশের সব সম্পদ ভোগ করছে-চুক্তি ছাড়াই, যুদ্ধ ছাড়াই।বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, কনটেন্ট, বাজার-সব ভারতের নিয়ন্ত্রণে।আমাদের অর্থনীতি ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া এখন নয়াদিল্লির করিডরে নির্ধারিত হয়।আর আমরা ভাবি-আমরা স্বাধীন। হ্যাঁ, আমরা স্বাধীন,কিন্তু নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা,যেখানে একদল “ক্রীতদাস বুদ্ধিজীবী” প্রতিদিন ভারতের স্বার্থে কাজ করে,আর জনগণ দেখে-“এই দেশ কার?”

নতুন শিক্ষা:হাসিনার পলায়ন,ভারতীয় ব্যর্থতা
২০২৫ সালের জুলাইয়ের পর হাসিনার পলায়নের দৃশ্য বিশ্বকে দেখিয়েছে-ভারত যাদের কোল ঘেঁষে ১৭ বছর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে,তাদের পতনের পর ভারত অসহায় দর্শক ছাড়া কিছু নয়।ভারত এখন বলছে-“বাংলাদেশকে ইউক্রেন বানাবে।”কিন্তু ভুলে যাচ্ছে-এ দেশ পাকিস্তানের মতো নয়,এই দেশের মাটি জানে-দখলদারদের কবর কীভাবে খোঁড়া হয়।

যদি ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ একক স্বাধীন হতো…
যদি সে সময়ে পাকিস্তান বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত না করত,
তাহলে ভারত যেমন সিকিম, হায়দরাবাদ, গোয়া গিলে ফেলেছিল,তেমনভাবেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকত না।
তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মে বাংলাদেশের বেঁচে থাকা নিশ্চিত হয়েছিল-এটাই কঠিন, তবু সত্য ইতিহাস।

বাংলাদেশ এখন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে।আমাদের স্বাধীনতা যদি শুধু মুদ্রায়, ট্রেডে ও নীতিতে ভারতের হাতে থাকে,
তবে সেটি “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” নয়-“ভারতের অর্জন”।
যারা আজও ভারতের দাসত্বে গর্ববোধ করে,তাদের জন্য শিক্ষা কেবল ইতিহাসে নয়-এবার তা হবে বাস্তবে, রাস্তায়, রক্তে।

বাংলাদেশের প্রকৃত মুক্তি শুরু হবে যেদিন আমরা “হাইজ্যাকড ইতিহাস”ফেরত নিয়ে,নিজের ইতিহাস নিজের হাতে লিখব।”

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-নবজাগরণ