মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
দীর্ঘ অন্ধকার শেষে সত্যের আলোর ঝলক
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় অবিচারের অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্যতম-সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত অফিসারদের ওপর ধারাবাহিক গুম,বন্দিত্ব,বরখাস্ত,অপবাদ, জঙ্গি ট্যাগ, পরিবার ধ্বংস এবং বিচারহীনতা।বিগত সরকারের নিষ্ঠুর নীরবতা, রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষাঘাত, ভারতীয় প্রভাবের রাজনৈতিক দখলদারিত্ব-সব মিলিয়ে এই দেশটিকে একসময় মনে হয়েছিল একটি বিশাল কারাগার।আজ সেই কালো অধ্যায় ভাঙছে।কারণ-প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছেন-বঞ্চিত সদস্যদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।এই একটি বাক্য হাজারো নির্যাতিত পরিবারে প্রথমবারের মতো আলো জ্বালিয়েছে।
রাষ্ট্রীয় গুমের ভয়াবহ বাস্তবতা-যা কল্পনার বাইরে!
যে তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে,তা শুধু ভয়াবহ নয়- বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো কতটা পচে গিয়েছিল তার নির্মম প্রমাণ।ছয় অফিসারকে গুম:১ বছর থেকে ৮ বছর!
তাদের কোনো অপরাধ ছিল না,কোনো সামরিক ব্যর্থতা ছিল না, কোনো ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন না-শুধু তাদের পরিবারে কারো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে তাদের “বিপজ্জনক” বলা হয়।একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে নৃশংস হত্যা মিথ্যা জঙ্গি নাটক সাজিয়ে হত্যা!একজন শিশুসহ স্ত্রীকে ৬ বছর কারাগারে রাখা!-এমন ঘটনা কোনো
সভ্য রাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না।২৫ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পর সরকারের সমালোচনা করায় পাঁচ অফিসারকে নির্যাতন তারা শুধু প্রশ্ন করেছিলেন-কেন রাষ্ট্র নিষ্ক্রিয়?সেটাই ছিল অপরাধ! ১/১১-তে ডিজিএফআই-এর অফিসাররা শিকার অভিযোগ ছাড়াই বরখাস্ত!এটাই ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।প্রধানমন্ত্রীর দরবারে প্রশ্ন করায় পাঁচ অফিসারকে বলির পাঁঠা বানানো তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগই দেওয়া হয়নি। এটা কি শত্রুর দেশে ঘটে? নাকি নিজ রাষ্ট্রে?ধর্মীয় আচার পালন করায় চার লেফটেন্যান্টকে‘জঙ্গি’ ট্যাগ এটাই ছিল আওয়ামী লীগের রাষ্ট্র-ধর্ম পালন করলে জঙ্গি,সত্য বললে দেশদ্রোহী, ন্যায় চাইলে নিখোঁজ।
তদন্ত কমিটির প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা
বিশেষভাবে ধন্যবাদ-লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ মেজর জেনারেল (অব.) মুহম্মদ শামস-উল-হুদা
মেজর জেনারেল (অব.) শেখ পাশা হাবিব উদ্দিন
রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ শফিউল আজম
এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মুহাম্মদ শাফকাত আলম তারা দেখিয়েছেন-অবসর মানে চুপ থাকা নয়।অবসর মানে দায়িত্বহীনতা নয়।অবসরেও একটি সত্যিকারের সৈনিক রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ান।
জুলাই বিপ্লব: যেদিন বাংলাদেশ কারাগার ভেঙেছিল
১৬ বছরের দুঃশাসন শুধু গণতন্ত্র শেষ করেনি,একটি জাতির শ্বাস বন্ধ করে দিয়েছিল।দেশের ওপর ভারতের সম্পূর্ণ দখলদারিত্ব, গোষ্ঠীগত লুটপাট,আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় দাসে পরিণত করা, বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক কারখানা বানানো-সবই ছিল একটি বৃহৎ নকশার অংশ।জুলাই বিপ্লব সেই নকশা ভেঙেছে।রাস্তায় রক্ত দিয়েছে ছাত্ররা,আহত হয়েছে সাংবাদিকরা, আমরা যারা গেছি গুলির সামনে-তাদের সংগ্রাম আজ রাষ্ট্রকে সত্য বলার সাহস দিয়েছে।
আহত সাংবাদিকরা: সত্য বলার অপরাধে আজও উপেক্ষিত!জুলাইয়ের আগুনে যারা রক্ত দিয়ে দেশ বাঁচিয়েছেন-যেসব সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, হাত-পা ভেঙে গেছে, চোখ নষ্ট হয়েছে-তাদের নাম এখনো MIS তালিকার গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।এটা কীভাবে সম্ভব?একদিকে রাষ্ট্র অন্যায়ের সত্য স্বীকার করছে,অন্যদিকে সেই রাষ্ট্রই জুলাই বিপ্লবের আহতদের নাম প্রকাশে বিলম্ব করছে।এটা কি অযোগ্যতা?না কি অবহেলা?নাকি আমলাতান্ত্রিক নীরব অভ্যাস?যাই হোক-এটা অগ্রহণযোগ্য।রাষ্ট্র যখন ন্যায়বিচারের পথে হাঁটছে, তখনই সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা-মানসিকতার আহতদের নাম গেজেটে প্রকাশ করা সবচেয়ে জরুরি কাজ।
গেজেট বিলম্ব মানে রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করা
জুলাই বিপ্লব কোনো দলের আন্দোলন ছিল না।এটি ছিল পুরো জাতির মুক্তির সংগ্রাম।এই সংগ্রামের সৈনিকদের স্বীকৃতি না দেওয়া মানে-রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস দুর্বল করা।ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতিতে সন্দেহ তৈরি করা।শহীদ ও আহতদের বেদনার প্রতি চরম অসম্মান করা।এখন সময়-গেজেট প্রকাশ করে জাতির সামনে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার-রাষ্ট্র আপনাদের ভুলে যায়নি।
ভারতীয় দখলনীতি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের অপহরণ বাংলাদেশ গত ১৬ বছরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয়-এটি পরিণত হয়েছিল ভারতীয় নীতি বাস্তবায়নের পরীক্ষাগার।সীমান্তে হত্যা চুক্তি ছাড়া পানি সরিয়ে নেওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর তদারকি গোয়েন্দা সংস্থায় প্রভাব রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ভারতীয় অনুমোদন প্রশাসনকে ভারতের প্রতি দায়বদ্ধ রাখা এই পরিবেশে যে অফিসাররা দেশপ্রেম দেখিয়েছেন-তাদেরকে বরখাস্ত, গুম, নির্যাতন করা হয়েছে।কারণ তারা একটি বিদেশ-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।জুলাই বিপ্লব সেই বিদেশী ছায়াশাসনকে ভেঙেছে।
নতুন বাংলাদেশ: যেখানে ন্যায়বিচার আর গুণ্ডাতন্ত্র একই ছাদের নিচে থাকতে পারবে না প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য কেবল একটি মন্তব্য নয়-এটি একটি ঘোষণা:রাষ্ট্র একদলীয় নিষ্ঠুরতার শৃঙ্খল ভেঙে ন্যায়বিচারের পথে হাঁটছে।এই পথে প্রথম কাজ-গুম হওয়া অফিসারদের পূর্ণাঙ্গ বিচার জঙ্গি নাটকের নির্দেশদাতাদের গ্রেফতার জুলাই আহতদের গেজেট প্রকাশ আমলাতন্ত্রের দায়ী ব্যক্তিদের অপসারণ বিদেশ-নির্ভর রাষ্ট্রনীতি ছিন্ন করা সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সত্য সংবাদ বলায় আহত সাংবাদিকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এই কাজগুলো না হলে বিপ্লব অপূর্ণ থাকবে।
বাংলাদেশ আর কারাগার নয়-একটি নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ চলছে আজ আমরা দাঁড়িয়েছি এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে-একদিকে অন্ধকারের গহ্বর,অন্যদিকে ন্যায়বিচারের আলো।জুলাই বিপ্লব সেই আলো ধরেছে হাতে।এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব-এই আলোকযাত্রা সম্পূর্ণ করা।যারা গুম হয়েছেন-যারা শহীদ হয়েছেন-যারা আহত হয়েছেন-যারা সত্য বলেছেন-যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন-তাদের রক্ত, তাদের অশ্রু, তাদের ত্যাগকে সম্মান জানাবার একটাই পথ-সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা।ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করা।গেজেট প্রকাশ করা।এবং রাষ্ট্রকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক;নবজাগরণ-জুলাই যোদ্ধা আহত সাংবাদিক
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com




